সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন ফুলগাজীর আনন্দপুর ইউনিয়নের হাসানপুরের সম্ভ্রান্ত মজুমদার বাড়ীর সন্তান ড. মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদার। মানুষের স্বপ্ন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও বিচার ব্যবস্থা সংস্কারে করণীয় বিষয়ে দৈনিক ফেনীর সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
দৈনিক ফেনী : দীর্ঘ সময় বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে আবারো বিচারপতি নিয়োগ পাওয়ায় আপনার অনুভূতি বলুন।
মো. গোলাম মর্তুজা : ২০০৪, ২০০৮ ও ২০১২ সালে বিচারপতি নিয়োগ প্যানেলেও আমার নাম ছিল। বিশ বছর আগেও হয়তো নিয়োগ পেতাম। আগে নিয়োগ পেলে দেশের ও মানুষের কল্যাণে আরও বেশিকিছু করতে পারতাম। বঞ্চিত হলো জনগণ। আমার যোগ্যতা প্রমাণিত। শেষ পর্যন্ত হলো, কোন তদবির করিনি। হয়তো খোঁজ-খবর নিয়েছে, আমি মানুষের সেবা করতে পারবো।
দৈনিক ফেনী : বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলা হয়। তবুও মানুষ ন্যায়বিচার চেয়ে যখন বঞ্চিত হয়, এক্ষেত্রে বিচারকের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?
মো. গোলাম মর্তুজা : আদালতে মানুষ যখন ন্যায়বিচার পায় না তখন যাওয়ার আর জায়গা থাকে না। বিচারক যদি পক্ষপাতদুষ্ট ও দুর্বল হন, ভয় পান, তখন মানুষের আর যাওয়ার জায়গা থাকে না। এটিও বড় অবিচার। বিচারকদের সাহসী হতে হবে। সব জায়গায় ব্যর্থ হয়ে মানুষ আদালতে আসে। যদি ন্যায়বিচার না পায়, দেশের জন্য এরচেয়ে দুঃখজনক আর কিছু নেই। এজন্য ভালো বিচারক নিয়োগ দিতে হবে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দুর্বল লোকদের বিচারক বানালে বা এ ধরনের মানসিকতা থাকলে মানুষ বিচার পাবে কোথা থেকে? কলা গাছ থেকে তো আম পাবো না।
দৈনিক ফেনী : রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারক নিয়োগ করা হলে মানুষ সুবিচার পাবে কি না?
মো. গোলাম মর্তুজা : বিচারপ্রার্থী ন্যায়বিচার কখন পাচ্ছে, কখন পাচ্ছে না, গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে আপনারাও জানেন। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে বা দলীয়ভাবে নিয়োগ করা হলে এমনই হবে। এজন্য নিয়োগ পদ্ধতি ঠিক করতে হবে। বিচার বিভাগের সংস্কারে আমার ২৫-৩০টি প্রস্তাবনা আছে। মেধাবী যাচাই করে পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ দিতে হবে। দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারবে না। সততা ও আচরণ, একাডেমিক পারফরম্যান্স দেখতে হবে। নিরপেক্ষ লোক নিতে হবে। এগুলো না হলে ন্যায়বিচার আশা করবেন কী করে। নিয়োগ প্রদানের ক্ষেত্রে যে কমিটি থাকবে তা নিরপেক্ষ থাকবে। কমিটির লোকজন দলীয় হলে তাহলে পছন্দের লোক নিয়োগ পাবে। এজন্য দেখেশুনে করা উচিত। আমাদের রাজনীতি এদেশের মানুষকে এমনভাবে ক্ষতি করেছে যে, সার্বিকভাবে নিরপেক্ষ লোক পাওয়া কঠিন। শুধু বিচারক নয় অথরিটিকেও নিরপেক্ষ হতে হবে। পরীক্ষা বা ট্রান্সপারেন্সি কমিটি যদি নিরপেক্ষ না হয়, দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, তাহলে দলীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তখন বিচারক দলভুক্ত হয়ে যায়।
দৈনিক ফেনী : যেসকল রায় প্রদান করা হয় তা কী অপরাধীর সংশোধনের জন্য দেওয়া হয়?
মো. গোলাম মর্তুজা : ফৌজদারি অপরাধে শাস্তির ৪টি উদ্দেশ্য থাকে। সংশোধনমূলক, দৃষ্টান্তমূলক, লঘুদণ্ড ও গুরুদণ্ড। এগুলো আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। আমরা বহুবার আমাদের প্রস্তাবনায় বলেছি। জুডিশিয়াল এসোসিয়েশনের দুইবার মহাসচিব থাকার সময় সভা, সেমিনারে এগুলো মন্ত্রীদের বলেছি। তৎকালীন মাননীয় প্রধান বিচারপতি সাহাব উদ্দিন সাহেবের সাথে কাজ করেছি। একমাত্র তিনিই এগুলো করেছেন। ছোটখাটো অপরাধের জন্য জেল দেওয়ার প্রয়োজন নেই। অবস্থাভেদে ছেড়ে দেওয়া, জরিমানা বা ১-২ দিনের জেল দিলেই হয়। লঘুদণ্ডে জেল দিয়ে কী লাভ হয়। ওই ব্যক্তিকে তিনবেলা খাওয়াবেন, এগুলো জনগণের টাকা। শাস্তি দিয়ে একটি মানুষকে থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা- এতো টাকা নষ্ট, এতে কী ফায়দা হলো। তাকে শাস্তি দিয়ে আপনি কোথায় রাখছেন। একটা ভালো মানুষ ভুল করে একটা অপরাধ করলো তাকে জেলে রেখে ক্রিমিনালদের সাথে রেখে দিলেন। এসব অপরাধীদের সাথে তার ওঠাবসা আলোচনা। এরপর শাস্তি পেয়ে বের হয়ে তিনিও ক্রিমিনাল হয়ে যেতে পারেন। এসবের পরিবর্তন দরকার। সংস্কারের প্রয়োজন আছে। একটা সংস্কার কমিটি হয়েছে, এগুলো নিয়ে আমরা কথা বলবো।
দৈনিক ফেনী : সরকারের তল্পিবাহক হয়ে আইনী কাঠামোতে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা কতটুকু আশা করা যায়?
মো. গোলাম মর্তুজা : ধীরে ধীরে সব হবে। আমাদের মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেছেন স্বাধীন সচিবালয় প্রয়োজন। আশা করা যায়, সম্পূর্ণ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা চলছে। আমাদের মতো এই গরীব দেশগুলোতে ভালো কোথাও নেই।
দৈনিক ফেনী : সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্বাধীন গণমাধ্যম ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রয়োজন কতটুকু?
মো. গোলাম মর্তুজা : সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন স্বাধীন গণমাধ্যম। গণমাধ্যম স্বাধীন ও শক্তিশালী হলে বিচার বিভাগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে শক্তিশালী হবে। নির্ভয়ে, নির্বিঘ্নে বিচারকের বিরুদ্ধে লিখতে পারলে তাহলে বিচারকও শিখতে পারবেন। এজন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রয়োজন। সাংবাদিককে সৎ ও সাহসী হতে হবে, পড়াশোনার চর্চা করতে হবে।
দৈনিক ফেনী : ন্যায়বিচারে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের জন্য কী পদক্ষেপ প্রয়োজনীয়?
মো. গোলাম মর্তুজা : আমার সংস্কারের প্রস্তাবনায় এটিও আছে। একটি মানুষ একটি রায়ের বিরুদ্ধে ঢাকায় এসে হোটেল ভাড়া করে থাকবে, খাবে। দীর্ঘদিন ধরে চলবে। উকিল-মোক্তার চেনে না। কোথায় যাবে, কী করবে, কীভাবে মামলা চালাবে-এমন অনেক বিষয় রয়েছে। শুধু ঢাকার মানুষ বিচার পেলে তো হবে না, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, কক্সবাজারের লোকজন কীভাবে বিচার পাবে? অবশ্যই এর বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন।
দৈনিক ফেনী : তৃণমূলে সংবাদ প্রকাশে প্রতিবন্ধকতা দূর করতে করণীয় কী হতে পারে?
মো. গোলাম মর্তুজা : বিচারক ও সাংবাদিকদের নীতিমালা একই ধরনের হতে হবে। নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান, নিরপেক্ষ লোক লাগবে। প্রেস কাউন্সিল স্বাধীন কী না জানি না। যা হোক একটা অথরিটি লাগবে দেখভাল করবে, প্রটেকশন দরকার। একটি নিউজ লিখতে গিয়ে মারা পড়বে, মানুষের জীবনতো একটাই। সাংবাদিকদের ঘর-সংসার আছে। এজন্যই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এগুলো গবেষণার প্রয়োজন। অনেকেই একটা পত্রিকা খুলে বসে আছে, পয়সা দরকার, ইলেকশন দরকার, নিজেদের সংবাদ প্রকাশের দরকার। তখন সাংবাদিকতার মুখ্য বিষয় থাকে না। কেউ কাউকে চায় না। আপনাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। জুডিশিয়ারি স্বাধীন থাকুক তা কোন দেশই চায় না।
দৈনিক ফেনী : আপনার মূল্যবান সময়ের জন্য ধন্যবাদ।
গোলাম মর্তুজা : দৈনিক ফেনী পরিবারকেও ধন্যবাদ।
ড. মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদার ১৯৬০ সালের ১৫ জানুয়ারি ফুলগাজীতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৃত মফিজুর রহমান মজুমদারের ৮ ছেলে ও ৫ মেয়ের মধ্যে তিনি চতুর্থ। ১৯৭৫ সালে ফুলগাজী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় হতে এসএসসি, ১৯৭৭ সালে ফেনী সরকারি কলেজ উচ্চ মাধ্যমিক, ১৯৮১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি অনার্স ও পরবর্তীতে এলএলএম সম্পন্ন করেন। তিনি ২০০৩ সালে ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০৭ সালে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কমনওয়েলথ ফেলোশিপ ও ২০১০ সালে ইংল্যান্ড থেকে পিএইচডি ১ম পর্ব এবং আমেরিকা থেকে চুড়ান্ত পর্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৮২ সালে বিসিএস কর্মকর্তা হিসেবে ড. গোলাম মর্তুজা কর্মজীবনে যোগ দেন।