বর্তমানে অনলাইনে বিভিন্ন ভোগ্য পণ্য বিক্রি হচ্ছে এবং এটি অনেক জনপ্রিয় একটি প্রক্রিয়া হয়ে উঠেছে ক্রেতাদের কাছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে ওষুধ, পোশাক, ইলেকট্রনিক্স এবং অন্যান্য গৃহস্থালি পণ্য অনলাইনে সহজেই কেনা যাচ্ছে। অনলাইন কেনাকাটার সুবিধা যেমন বাড়ছে, তেমনই পণ্যের মান নিয়ে প্রতারণার ঘটনাও ঘটছে। অনেকে অনলাইন থেকে কেনা পণ্যের মান নিয়ে সন্তুষ্ট হলেও, বেশির ভাগ অনলাইন ক্রেতার নিম্নমান ও ভেজাল নিয়ে অভিযোগ রয়েছে।
ফেনী শহরের নাজির রোড এলাকার বাসিন্দা হাসান মাহমুদ বলেন, অনলাইনে কেনাকাটা আমাদের জন্য সহজ এবং সুবিধাজনক কিন্তু আমি অনেক সময় পণ্যের গুণগত মান নিয়ে অসন্তুষ্ট। কিছু পণ্য আসার পর বুঝতে পারি সেগুলো বিজ্ঞাপনের মতো নয়। বিজ্ঞাপনে থাকে এক রকম হাতে পাওয়ার পর দেখি আরেক রকম।
রিনা সুলতানা নামের এক গৃহিণী বলেন, আমি অনেকবার অনলাইনে খাদ্যপণ্য অর্ডার করেছি, কিন্তু কিছু কিছু সময় পণ্যটি আসার পর দেখি তা মানসম্মত নয়। পরবর্তীতে সেটি ফেলে দিতে হয়। সরকারের উচিত এসবের অনলাইন পণ্যের মানগুলো সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা।
শারমিন আক্তার নামের আরেক গৃহিণী বলেন, অনলাইনে আমি ফেসবুকে বিভিন্ন পেইজের মাধ্যমে প্রসাধনী সামগ্রী ক্রয় করে থাকি থেকে। প্রসাধনী সামগ্রীগুলো ব্যবহার করার পর দেখা যায় ত্বকে ব্রণ, চুলকানো, ব্ল্যাকহেডস, মেছতাসহ নানান সমস্যা দেখা যায়। কিন্তু পরে ব্যবহার করে বুঝতে পারি যে পণ্যগুলো নিম্নমানের।
লতিফ আহমেদ নামের এক চাকুরিজীবী বলেন, অনলাইনে একটা ওয়েবসাইট থেকে মধু ক্রয় করেছিলাম। ক্রয় করার পর যখন হাতে পাই তখন খুলে দেখি মধুতে চিনি মেশানো। খাঁটি মধুর বিজ্ঞাপন দেখে ক্রয় করেছি হাতে নেওয়ার পর বুঝতে পারি আমি প্রতারণার শিকার হলাম।
অনলাইনে ভোগ্য পণ্য বিক্রি করা ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের কাছে পণ্যের মান সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা জানান, আমরা ভোক্তাদের কাছে শুধুমাত্র সরকারি দপ্তরের অনুমোদনকৃত প্রতিষ্ঠানের পণ্য বিক্রি করি এবং এসব পণ্যের মান সঠিকভাবে নিশ্চিত করে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করি।
ই-কমার্স ব্যবসায়ী ইনসা অর্গানিক শপের বিক্রেতা মো. ইফাদ উদ্দিন দৈনিক ফেনীকে জানান, আমরা অনলাইনে যে ভোগ্য পণ্য বিক্রি করি সেগুলো বিএসটিআইয়ের লাইসেন্সকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করে বিক্রি করি। এছাড়া কখনো কখনো আমরা স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকেও পণ্য সংগ্রহ করি। সেক্ষেত্রে পণ্যেগুলো কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত সেটি বলা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে ক্রেতারা পণ্যেগুলো সম্পর্কে ভালো রিভিউ দিয়ে থাকে এবং আমরা মানসম্মত পণ্য ক্রেতাদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করি।
অনলাইন প্রসাধনী সামগ্রী বিক্রি করে সুরাইয়া ইসলাম নামের এক ই-কর্মাস ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, আমরা মানের ব্যাপারে সবসময় সজাগ থাকি। পণ্যের মান ঠিক না থাকলে আমার কাস্টমার আমার থেকে দ্বিতীয় বার পণ্য ক্রয় করবে না। আমরা সরকারি দপ্তরের অনুমোদিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য ক্রয় করে বিক্রি করি। আমরা চাই যেন আমাদের কাস্টমার'রা ভালো এবং মানসম্মত পণ্যটি হাতে পায়।
মো. সবুজ নামের আরেক ই-কর্মাস ব্যবসায়ী বলেন, আমরা গুণগত মানের পণ্য সরবরাহে সচেষ্ট থাকি কিন্তু অনেক সময় ক্রেতারা কম দামে পণ্য কেনার জন্য মানহীন বিক্রেতাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ওই বিক্রেতার জন্য ভোক্তাদের আমাদের উপর সে বিশ্বাসটা উঠে যায়।
ক্রেতাদের সচেতন হতে হবে
অনলাইনে কেনাকাটার ক্ষেত্রে ক্রেতাদের প্রায়ই নিম্নমানের পণ্যের শিকার হতে হয়। ক্রেতাদের অধিকাংশই পণ্যের গুণগত মান সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশে ভোগ্য পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন সরকারি সংস্থা কাজ করছে। এর মধ্যে বিএসটিআই (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন) এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর উল্লেখযোগ্য। এই সংস্থাগুলো পণ্যের মান পরীক্ষণ, স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ, এবং বাজার মনিটরিংয়ের দায়িত্বে রয়েছে। বিএসটিআই প্রধানত খাদ্যপণ্য এবং অন্যান্য ভোগ্য পণ্যের মান পরীক্ষা ও নির্ধারণ করে। তারা পণ্যের সঠিক মান বজায় রাখা এবং স্বাস্থ্যসম্মত প্রক্রিয়ায় উৎপাদনের বিষয়টি তদারকি করে থাকেন এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ক্রেতাদের অধিকার রক্ষা এবং নিম্ন মানের পণ্য বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কাজ করে থাকে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ফেনী জেলার সহকারী পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) কাউছার মিয়া বলেন, আমরা চাইনা ভোক্তারা অনলাইন থেকে পণ্য কিনে প্রতারিত হোক। অনলাইনের অনেক কিছু আমাদের নাগালের বাহিরে থাকে। অনলাইনের মাধ্যমে পণ্য কিনে প্রতারিত হলে ভোক্তা অধিদপ্তরের প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবের কারণে ভোক্তাদের প্রতিকার দেওয়ার সে সক্ষমতা নেই। এ জন্য ভোক্তাদের সচেতন হতে হবে। তিনি আরও বলেন, অনলাইনে পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে সর্বদা প্রতিষ্ঠানের বৈধতা নিশ্চিত করা জরুরি। যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ওয়েবসাইট বা পেইজ থাকে, তবেই সেখান থেকে পণ্য ক্রয় করা উচিত। এভাবে ক্রয় করলে যদি ভোক্তারা প্রতারিত হন তখন সে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিকার আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
বিএসটিআই নোয়াখালী আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (সিএম) জিশান আহমেদ তালুকদার বলেন, বর্তমানে অনলাইনের মার্কেট ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বাস্তবিকভাবে একটি বিক্রয়ের পলিসি হিসেবে কাজ করছে। আমাদের লক্ষ্য হলো, অনলাইনে বিক্রি হওয়া পণ্যের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সঠিকভাবে ট্র্যাক করা এবং বিশেষ করে যে প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স নেই সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এছাড়া যাদের লাইসেন্স রয়েছে, তাদের নিয়মিত মনিটরিং করে নিশ্চিত করছি যে তারা সকল মানদণ্ড মেনে চলছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা লক্ষ্য করছি কিছু কিছু ফেসবুক পেইজ অসৎ উদ্দেশ্যে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ছাড়াই চটকাদার বিজ্ঞাপন দিয়ে দাবি করছে যে তাদের বিএসটিআইয়ের অনুমোদন আছে। সেক্ষেত্রে ভোক্তারা বিএসটিআইয়ের অনুমোদন আছে ভেবে পণ্যটি ক্রয় করে প্রতারিত হন। এগুলো বিরুদ্ধে আমাদের এক্সপার্ট টিম কাজ করে যাচ্ছে।
বিএসটিআইয়ের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, অনলাইনে ভোগ্য পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ভোক্তাকে সচেতন হতে হবে। বিএসটিআইয়ের অনুমোদিত পণ্য কিনা যদি অনুমোদিত হয় সে ক্ষেত্রে কিউআর কোড এবং সিল দেখে ক্রয় করতে হবে। এছাড়াও অনলাইন পণ্য কিনে প্রতারিত হয়েছে এমন কোনো ভোক্তার অভিযোগ পেলে বিএসটিআই অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে বলে জানান এই কর্মকর্তা।