ডিমের বাজারে আবারও বেড়েছে অস্থিরতা। এই অস্থিরতা অনেকটা উদ্বেগের কারণ হয়েছে দাঁড়িয়েছে ডিমের ওপর নির্ভরশীল ব্যাচেলর, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষগুলোর কাছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেশি হওয়ার কারণে বেড়েছে ডিমের দামের এই উর্ধ্বগতি।
গতকাল সোমবার (৭ অক্টোবর) ফেনী বড় বাজার, সুলতান মাহমুদ পৌর হকার্স মার্কেট, মহিপাল বাজার, মুক্ত বাজারসহ পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি ডজন লেয়ার মুরগির ডিমের দাম ২৫-৩০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। খুচরা বাজারগুলোতে প্রতি পিস লেয়ার মুরগির ডিমের দাম ১৪-১৫ টাকা। প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৬০-১৭০ টাকা পর্যন্ত। এমন অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির দৈনন্দিন ব্যয় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে জানায় সাধারণ ভোক্তারা।
পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, ফেনীতে ভয়াবহ বন্যার কারণে পোল্ট্রি খাতে অনেক বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে যার কারণে ফেনীতে ডিমের তেমন সরবরাহ নেই। ডিমের সরবরাহ না থাকার কারণে প্রতি পিস ডিমের দাম ৩ থেকে ৪ টাকা করে বেড়েছে। তারা বলছেন, পোল্ট্রি ফার্ম থেকে আমরা বেশিরভাগ ডিম কিনে থাকি। বন্যার ক্ষতির কারণে পোল্ট্রি ফার্মগুলোতে ডিমের উৎপাদন এখন আগের মতো নেই। এছাড়াও, মুরগির খাদ্যের দামও বেড়েছে। সবকিছু মিলিয়ে তাই ডিমের দাম এখন বাড়তি।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারি বাজার থেকে মূল্য ঠিক করা হয়ে থাকে। পাইকারিতে বেশি দাম দিয়ে কিনতে হলে আমাদের বেশি দামে বিক্রি করতে হয়।
বড় বাজারে খুচরা বিক্রেতা মোস্তফা কামাল বলেন, পোল্ট্রি ফার্মগুলোতে ডিমের উৎপাদন আগের চেয়ে কয়েকগুণ কমেছে। পাশাপাশি মুরগির খাদ্য ও পরিবহন খরচ বাড়ায় এ দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, আমরা চাই না ক্রেতাদের কাছে অতিরিক্ত দামে ডিম বিক্রি করতে, কিন্তু আমাদেরও ব্যবসা চালাতে হলে লাভ রাখতে হয়।
পাইকারি বিক্রেতা নাসির উদ্দিন জানান, এই দাম বৃদ্ধির পেছনে আমাদের তেমন কিছু করার নেই। পোল্ট্রি ফার্মগুলো থেকে ডিমের উৎপাদন অনেক কমেছে বন্যার ক্ষতির কারণে। যার কারণে ডিমের দাম বাড়তি। আমরা জানি, এতে ক্রেতারা অসন্তুষ্ট, কিন্তু আমাদেরও খরচ অনেক বেড়ে গেছে।
জেলা পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. কামরুল আলম বলেন, বন্যার আগে জেলার পোল্ট্রি ফার্মগুলোতে ডিমের উৎপাদন অনেক হতো। পোল্ট্রি ফার্মগুলো জেলায় ডিমের চাহিদা মিটিয়ে বাহিরের জেলাগুলোতেও সরবরাহ করে থাকে। কিন্তু ফেনীর স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কারণে পোল্ট্রি ফার্মগুলো প্রায়ই ক্ষতির সম্মুখীন। বর্তমানে এই ডিমের উৎপাদন ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। দাম বৃদ্ধি নিয়ে তিনি বলেন, শাক-সবজির দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের ডিমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যার কারণে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে দামও বেড়েছে।
জেলা প্রাণীসম্পদ দপ্তরের তথ্যমতে, বন্যা পরবর্তী পুরো জেলায় প্রতিদিন ডিমের চাহিদা ৪ লাখ ১২ হাজার ৫৫৯ পিস এবং প্রতিদিন উৎপাদন হচ্ছে তিন লাখ ৩ হাজার ৪০০ পিস। এর মধ্যে ফেনী সদরে ডিমের চাহিদা ১ লাখ ২০ বাজার পিস উৎপাদন হয় ৬২ হাজার পিস, ফুলগাজী উপজেলায় চাহিদা রয়েছে ৪৯ হাজার ৯০০ পিস ও উৎপাদন হয় ৩৯ হাজার পিস, ছাগলনাইয়া উপজেলায় চাহিদা ৫৮ হাজার পিস এবং উৎপাদন হয় ৪০ হাজার পিস। পরশুরাম উপজেলায় চাহিদা ২৯ হাজার ১৪২ পিস ও উৎপাদন ২৩ হাজার ২০০ পিস। দাগনভূঞা উপজেলায় ডিমের চাহিদা ৭২ হাজার ৬৮৬ পিস ও উৎপাদন ৬৬ হাজার ৬৫০ পিস এবং সোনাগাজী উপজেলায় চাহিদা ৮২ হাজার ৮২১ পিস ও উৎপাদন হয় ৭২ হাজার ৫৫০ পিস।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা: মো: মোজাম্মেল হক জানায়, ফেনী জেলায় বন্যার কারণে পোল্ট্রি ফার্মগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার কারণে জেলায় আগের তুলনায় ডিমের উৎপাদন অনেকটা কমেছে। দাম বৃদ্ধি নিয়ে তিনি বলেন, ডিমের দাম বাণিজ্য মন্ত্রনালয় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
হতাশ সাধারণ মানুষ
সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি পিস ডিমে ২-৩ টাকা করে বেড়েছে। ডিমের এই অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণে সাধারণ ভোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সাধারণ মানুষের খাদ্য তালিকায় প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাচেলর, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষগুলো চরম বিপাকে পড়েছে। এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে ভোক্তারা, তারা বলছেন, দিনদিন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু আয় বাড়ছে না। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য দাম বৃদ্ধি পাওয়া অনেকটা উদ্বেগের কারণ।
বাজার করতে আসা শহরের বাসিন্দা মাসুদ রানা বলেন, ডিম সবসময় সাশ্রয়ী প্রোটিনের উৎস ছিল, কিন্তু এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে আমাদের অনেকেই ডিম কেনা কমিয়ে দিতে হচ্ছে। এক মাস আগে ১০-১১ টাকা ছিল। সেটি এখন পাইকারি ১৪ ও খুচরা ১৫ টাকাতে গিয়ে থেমেছে।
মজিবুর রহমান নামের এক রিকশাচালক তার অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ডিম তো গরিবের খাদ্য এখন সেই ডিমও কিনতে হচ্ছে বাড়তি দামে। খরচ বাড়ে কিন্তু আয় বাড়ে না। আমাদের মতো যারা দিন এনে দিনে খায় তাদের কাছে ৩-৪ টাকা বৃদ্ধি পাওয়া অনেকটা হতাশার কারণে।
হাসানুল হক নামের আরেক ভোক্তা বলেন, আমরা একেবারেই বিপদে আছি। প্রতিদিন দাম বাড়ছে, কিন্তু আয় তো বাড়ছে না। বাজারে গেলে এখন প্রতিটা জিনিসের দাম বাড়তি লাগে ডিমও এর ব্যতিক্রম নয়। গত মাসে ডিম কিনেছি ডজন প্রতি
১৪৫ টাকা করে আর এখন ডজনে ২০-৩০ টাকা বাড়তি দিতে হচ্ছে।
ফেনীর এক মেসে থাকা মাহমুদুল হাসান বলেন, আমরা ব্যাচেলররা অনেক সময় সস্তা আর সহজ খাবার হিসেবে ডিমের ওপর ভরসা করি। একটা ডিম ভাজি করে ডাল-ভাত খেলে দিনটা কেটে যায়। কিন্তু এখন প্রতি ডজন ডিমের দাম এত বেড়ে গেছে যে, প্রতিদিন ডিম খাওয়াও কঠিন হয়ে পড়ছে।
তার বন্ধু সাইফুল ইসলাম বলেন, বাইরে খাবার খেতে গেলে অনেক টাকা খরচ হয়, তাই আমরা বাসায় ডিম রান্না করি। কিন্তু এখন একটা ডিমের দাম ১৪-১৫টাকা হয়ে যাওয়ায় সেটাও আর সহজ নেই।