ফেনীতে শতাব্দী ভয়াবহ বন্যার এক মাস পার হয়ে গেলেও মোছেনি স্বজন হারানোর কান্না। সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ফেনী সদরের লেমুয়া ইউনিয়নে গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে। স্মরণকালের এ ভয়াবহ বন্যায় স্বজন হারানোর বেদনা এখনও কোনভাবেই ভুলতে পারছেন না মানুষ।
বন্যায় পানির তীব্র স্রোতে ভেসে লেমুয়া ইউনিয়নের এক শিশু ও নারীর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বিকালে লেমুয়া ইউনিয়নের তেরবাড়িয়া গ্রামে বন্যায় পানিতে ভেসে নিহত শিশু জান্নাতুল সাইমার (৭) বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সন্তান হারানোর শোক কিছুতেই ভুলতে পারছেন তার বাবা-মা। গত ২২ আগস্ট বিকালে বাবা-মা’র সাথে ফেনীতে আসার সময় মহাসড়কের লালপোলে পানির তীব্র স্রোতে ভেসে যায় সাইমা। এ স্মৃতি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না সাইমার বাবা সালেহ আহমদ ভূঞা। এর সাপ্তাহখানেক পর ২৯ আগস্ট লালপোলে মেলে সাইমার লাশ।
বন্যার পানিতে ডুবে মারা যান ওই ইউনিয়নের নেয়ামতপুর গ্রামের কাজী এনামুল হকের স্ত্রী রেজিয়া বেগম। বাড়ি থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে পানিতে ডুবে মারা যান তিনি।
লেমুয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ফেরদৌস আহমেদ কোরাইশী বলেন, বন্যার পানিতে ডুবে রেজিয়া বেগম ও শিশু সাইমা প্রাণ হারিয়েছে। নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
সরকারিভাবে ফেনীতে ভয়াবহ বন্যায় ২৯ জনের মৃত্যুর তথ্য মিলেছে। এর মধ্যে ১৮ জন পুরুষ, সাতজন নারী ও চারটি শিশু রয়েছে। মারা যাওয়াদের মধ্যে ২০ জনের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে, অপর নয় জনের পরিচয় মেলেনি। অজ্ঞাত হিসেবেই দাফন হয়েছে ওই নয় জনের। জেলায় বন্যার ভয়াবহতা এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, নিহত অনেককে কবর দেওয়ার মাটি পাওয়া যায়নি। চিরকুট লিখে মরদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল কলাগাছের ভেলায়।
পুলিশের গোয়েন্দা শাখার তথ্যমতে, বন্যায় ফেনী সদরে আটজন, ফুলগাজীতে সাতজন, সোনাগাজীতে ছয়জন, দাগনভূঞায় তিনজন, ছাগলনাইয়ায় তিনজন ও পরশুরামের দুজন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে সোনাগাজীতে চারজন, ফেনী সদরে তিনজন এ ছাগলনাইয়ায় একজন অজ্ঞাত রয়েছে। এর বাইরেও একটি লাশ অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করা হয়েছে।
সরকারি হিসেবের বাইরে ফেনীতে বন্যায় প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি বলে ধারনা করছেন অনেকে।
টানা বর্ষণ ও ভারতীয় পাহাড়ি ঢলে গত ২১ আগস্ট সকাল থেকে ফেনীতে বন্যার ভয়াবহতা শুরু হয়। সীমান্তবর্তী পরশুরাম ও ফুলগাজীতে মুহুরী-কহুয়া-সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের অর্ধশতাধিক স্থানে ভাঙন ধরে প্রায় ১০ ফুট পানিতে প্লাবিত হয় জেলার ৯৫ শতাংশ এলাকা। অতি বৃষ্টি ও ভারত হতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ফেনীতে গত দেড় মাসে তিনবার বন্যা হয়েছে।
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ১১ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। ঘরের মধ্যে আটকা পড়েন কয়েক লাখ মানুষ। বের হতে না পারায় ঘরেই মারা যান কয়েকজন। শুধু সড়ক যোগাযোগ নয়, জেলায় মোবাইল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল পাঁচদিন। বন্যার ভয়াবহতায় শুধু মানুষের মৃত্যু নয় জেলাজুড়ে ঘর-বাড়ি, কৃষি, মৎস্য, গবাদি পশু-পাখি, সড়ক, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্যে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক ফেনী।
আকস্মিক এ বন্যার জন্য স্থানীয় মানুষ প্রতিবেশী দেশ ভারতকে দায়ী করছেন। যদিও ভারত সীমান্তবর্তী ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজী ও পরশুরামে বন্যা নিত্য ঘটনা। এর সঙ্গে লড়াই করে এসব অঞ্চলের মানুষেরা টিকে থাকলেও, এবারের বন্যা তাদের সমস্ত ধারণা পাল্টে দিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ভারত সরকার কোনো ধরনের সতর্কবার্তা না দিয়েই ফেনীর পাশের রাজ্য ত্রিপুরার ধলাই জেলায় গোমতী নদীর ওপরে থাকা ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দিয়েছে। ফলে অস্বাভাবিক এ বন্যা দেখা দিয়েছে।
বন্যায় ফেনীর ৯০ শতাংশ মানুষ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন বলে অক্সফাম প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
পানি নেমে গেলেও এ ক্ষতিপূরণে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ফেনীতে এমন মানবিক বিপর্যয়ের পেছনে স্থানীয়দের অভিযোগ, এ দুর্ভোগের কারণ ভারত।
কেউ কেউ এর মধ্যে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি রয়েছে বলেও মনে করছেন। এ নিয়ে নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলছে। ফেনীর এ মানবিক বিপর্যয় কাটাতে ক্রমেই ক্ষতিপূরণের দাবি জোরালো হচ্ছে।