গত ৪ আগস্ট মহিপালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয় সোনাগাজীর ধর্মভীরু তরুণ মাহবুবুল হাসান মাসুম (২৫)। পরিবারের সদস্যরা মানা করলেও দেশ ও দশের তরে শহিদ হতে কোন দ্বিধা ছিল না চট্টগ্রাম কলেজের সম্ভাবনাময় এই শিক্ষার্থীর। শহিদদের নিয়ে দৈনিক ফেনীর ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ চতুর্থ পর্বে পড়ুন অন্যায়ের বিরুদ্ধে শহিদ মাসুমের প্রতিবাদী ভূমিকার কথা
৪ আগস্ট ফেনীর মহিপালে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র মাহবুবুল হাসান মাসুম (২৫)। পরবর্তীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। সেদিন ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অসহযোগ কর্মসূচির প্রথম দিন। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নির্বিচারে গুলি করে গণহত্যা করে।
প্রথমে কোটা এবং পরে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনে যেতে পরিবারের নিষেধ থাকলেও ভাইবোনদের মাসুম বলতেন, ‘ঘরে থেকেও শিশু মারা যাচ্ছে, আমিও প্রয়োজনে শহীদ হব, এসময় আমরা ঘরে বসে থাকা অন্যায়’।
পরিবার সূত্র জানায়, মহিপালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে নির্বিচারে গুলিতে নিহত মাসুমের মাথায় ৩টি গুলিবিদ্ধ হয়। মাসুমের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান জানান, আন্দোলনের কারণে ফেনীতে থাকায় পরিবারের সাথে তার সর্বশেষ দেখা হয় ৮ জুলাই। পরিবারের সবাই চট্টগ্রাম থাকাতে মায়ের সাথে শেষ দেখা হয়নি মাসুমের।
মাহমুদুল হাসান বলেন, ভাইদের মধ্যে সে আমল ও আখলাখের দিক থেকে সবার থেকে আলাদা ছিলেন। পড়ালেখার পাশাপাশি পরিবারের ব্যবসাও দেখত মাসুম। ফেনীতে চা-পাতার ব্যবসা রয়েছে যা সে দেখভাল করত। আমার ভাই মারা গেছে দেশের জন্য, এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ৪ আগস্ট ১২টার দিকে মাসুমের সাথে আমার সর্বশেষ কথা হয়৷ তাকে বাসায় চলে যেতে বলার পর সে উত্তর দেয় নামাজ পড়ে বাসায় যাবে। নামাজের পরে তাকে ফোন দেওয়ার পর অন্য একজন রিসিভ করে। দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটের দিকে একজন বলেন মাসুম মারা গেছে, তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে ফেনী সদর হাসপাতাল থেকে সোনাগাজীর এক সাংবাদিকের মাধ্যমে খবর পাই সে জীবিত আছে৷ তাকে সাথে সাথে চট্টগ্রাম নিয়ে আসি। তার মাথায় ৩টি গুলি লাগে, একটি সামনের দিকে বাকি দুটি পেছনে।
কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, আমার ভাই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। তার পড়াশোনা শেষ পর্যায়ে। এখন আমাদের সুন্দরের সময় এসেছিল, তার আগেই সে চলে গেল।
তিনি বলেন, আমার ভাইয়েরা সবাই পড়ালেখায় শিক্ষিত। মেজ ভাই হাফেজ, সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেছে। ছোট ভাইও হাফেজ। সবাই সবার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আমার ভাই আমাদের রেখে চলে গেল, খুনিরা তাকে মেরে ফেলল।
এদিকে ছেলে হারানোর শোক এখনও ভুলতে পারছেন না মাসুমের মা ফেরদৌস আরা বেগম। শোকে এখনও আহাজারি করছেন তিনি। এ ঘটনার বিচার দাবি করে বলেন, আমার সবগুলো ছেলেই ইসলামের খেদমতে কাজ করেছে। আমার সেজ ছেলে দেশের জন্য শহীদ হয়েছে। আমার ছেলে হত্যার সাথে যারা জড়িত তাদের বিচার দাবি করছি।
এ ঘটনায় ইতোমধ্যে ৪ সেপ্টেম্বর রাতে ফেনী মডেল থানায় মামলা করেছেন নিহতের ভাই মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান। এ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় ১৬২ জনের নাম উল্লেখ ও আরও ৪০০-৫০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।
খুনিদের বিচার দাবি করে মাসুমের বড় ভাই বলেন, আমার ভাইয়ের খুনিদের সব প্রমাণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই আছে। কারা করেছে সবাই জানে, তাদের বিচার যেন এ বাংলায় হয়। জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন তিনি।
নিহত মাসুম সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের তোরাব পাটোয়ারী বাড়ির মৃত মাওলানা নোমান হাসানের ছেলে। ১৯৯৯ সালের ১৫ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পরিবারে তারা ৪ ভাই ও ৩ বোন। ভাইদের মধ্যে তিনি ৩য়। মাসুম ছাগলনাইয়া আব্দুল হক চৌধুরী ডিগ্রি কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক সম্পন্ন করেন। চট্টগ্রাম কলেজে বাংলায় স্নাতকোত্তর পড়ছিলেন। এর আগে তিনি ২০১৪ সালে সোনাগাজী দাখিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসা থেকে আলিম সম্পন্ন করেন। মাসুমের বাবা ছিলেন সাবেক মাদ্রাসা শিক্ষক ও মসজিদের ইমাম। তিনি ২০১৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। অন্যদিকে বড় ভাই মাহমুদুল হাসান এলএলবি পড়ার পাশাপাশি ব্যবসার সাথে জড়িত, মেজ ভাই হাফেজ মাহফুজুল হাসান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ছোট ভাই হাফেজ মনজুরুল ইসলাম মাহী ২০২৪ সালের আলিম পরীক্ষার্থী।