চলতি বছরে তিন দফায় বন্যার কবলে পড়েছে ফেনী। প্রথম দুই দফার বন্যায় ফুলগাজী ও পরশুরাম এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ২০ আগস্টের বন্যা ছিল স্মরণকালের ভয়াবহ অধ্যায়। এবারের বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। দৈনিক ফেনীর অনুসন্ধানে উঠে আসে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। ধারাবাহিক ছয় পর্বে এবং খন্ড সংবাদে দেখা গেছে, এবারের বন্যায় ক্ষতি আনুমানিক ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ২০ লাখ ৫০০ টাকা।

ফেনীতে এ বছর তৃতীয় দফায় শেষ বন্যায় মানুষের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ২০ লাখ ৫০০ টাকা। বন্যায় ক্ষতি প্রসঙ্গে দৈনিক ফেনীর ধারবাহিক ৬ পর্বের প্রতিবেদন এবং খন্ড সংবাদে উঠে এসেছে এমন তথ্য। ক্ষতি নিরূপণে কৃষিখাত, সড়ক যোগাযোগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্ষতি, মোটরযানে ক্ষতি, ঘরবাড়িতে ক্ষতি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ক্ষতি নিরূপণ করে উল্লিখিত ক্ষতির পরিমাণ হিসেব করা হয়েছে।

কৃষিখাতে ফসল, সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো মৎস্য ও প্রাণিসম্পদে আনুমানিক ক্ষতি নিরূপন করেছে ৯১৪ কোটি টাকা। তন্মধ্যে প্রাণিসম্পদ বিভাগ পোল্ট্রি এবং লাইভস্টকে ক্ষতি নিরূপণ করেছে প্রায় ৩৯৬ কোটি টাকা। তবে পোল্ট্রি উদ্যোক্তরা তাদের ক্ষতির পরিমাণ দাবি করেছেন ৪০০ কোটি টাকা। দৈনিক ফেনীর অনুসন্ধানে এ ক্ষতির আনুমানিক হিসেব দাঁড়ায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

এবারের বন্যায় ফেনীতে গ্রামীণ, আঞ্চলিক ও মহাসড়কে ১৪০ কোটি ৪৮ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। একইভাবে ৮৬৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং দপ্তরে বন্যায় ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে ৩৮ কোটি ৭২ লাখ ৫০০ টাকা। দৈনিক ফেনীর অনুসন্ধানে মোটরযানে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপিত হয়েছে প্রায় ৬১ কোটি টাকা। বন্যায় অবকাঠামো অর্থাৎ, ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, বৈদ্যুতিক সামগ্রির ক্ষয়ক্ষতি নিরূপিত হয়েছে আনুমানিক ৬৯২ কোটি টাকা এবং জেলাজুড়ে ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং শিল্প-কারখানার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে আনুমানিক ৫৫৪ কোটি টাকা।

একদিকে যেমন আকস্মিক অন্যদিকে অকল্পনীয়, ফেনীর মানুষের কাছে এবারের বন্যা ছিল এমনই। জেলার পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলা শুরুতে বন্যাকবলিত হলেও পরে ফেনী সদর, সোনাগাজী ও দাগনভূঞা ছড়িয়ে পড়ে। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে ফেনীর মানুষের জীবনে। টেলিযোগাযোগসহ সব ধরনের যোগাযোগ থমকে যায়। এই জেলার অনেক প্রবীণ বাসিন্দাদের স্মৃতিতে এমন বন্যার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাই আকস্মিক বন্যায় পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগও পাননি অনেকে।

স্মরণকালের এ ভয়াবহ বন্যায় সম্পদহানির পাশাপাশি ঘটেছে ব্যাপক প্রাণহানিও। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ফেনীতে বন্যায় ২৯ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। তন্মধ্যে ৯ জনের পরিচয় মেলেনি। জেলা প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়ে ১০ লক্ষাধিক মানুষ। তবে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে দাবি গণমাধ্যমের।

আকস্মিক এ বন্যার জন্য স্থানীয় মানুষ প্রতিবেশী দেশ ভারতকে দায়ী করছেন। যদিও ভারত সীমান্তবর্তী ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজী ও পরশুরামে বন্যা নিত্য ঘটনা। এর সঙ্গে লড়াই করে এসব অঞ্চলের মানুষেরা টিকে থাকলেও, এবারের বন্যা তাদের সমস্ত ধারণা পাল্টে দিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ভারত সরকার কোনো ধরনের সতর্কবার্তা না দিয়েই ফেনীর পাশের রাজ্য ত্রিপুরার ধলাই জেলায় গোমতী নদীর ওপরে থাকা ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দিয়েছে। ফলে অস্বাভাবিক এ বন্যা দেখা দিয়েছে।

সম্প্রতি অক্সফাম প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বন্যায় ফেনীর ৯০ শতাংশ মানুষ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশে আগে দেখা যায়নি। বন্যায় লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ি ও কৃষিজমি ডুবে গেছে। জীবিকা হারিয়েছে লাখ লাখ মানুষ। গবাদিপশুর ক্ষয়ক্ষতি, দুর্গত জনগোষ্ঠীকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

পানি নেমে গেলেও এ ক্ষতিপূরণে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ফেনীতে এমন মানবিক বিপর্যয়ের পেছনে স্থানীয়দের অভিযোগ, এ দুর্ভোগের কারণ ভারত। কেউ কেউ এর মধ্যে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি রয়েছে বলেও মনে করছেন। এ নিয়ে নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলছে। ফেনীর এ মানবিক বিপর্যয় কাটাতে ক্রমেই ক্ষতিপূরণের দাবি জোরালো হচ্ছে।