গত ৪ আগস্ট মহিপালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফেনীর ইতিহাসে ঘটে আরেকটি নির্মম গণহত্যার ঘটনা। দেশ ও দশের অধিকারের এ সংগ্রামে অংশ নিয়ে গুলিতে প্রাণ হারান ফেনীর মেধাবী ও উদীয়মান তরুণসহ নানা শ্রেণি পেশার সাধারণ মানুষ। আন্দোলনে ফেনীতে শহিদদের নিয়ে দৈনিক ফেনীর ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ প্রথম পর্বে পড়ুন শহিদ ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণের বীরত্বগাঁথা
ঢাকার রাজপথে অগণিত শিক্ষার্থীর রক্তস্রোত প্রতিবাদের ঢেউ তুলেছিল ফেনীতে শহিদ শ্রাবণের হৃদয়ে। মাকে বললেন, আম্মু, দেশে অবিচার হচ্ছে। প্রতিবাদ না করলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। উত্তাল জুলাইতে বৈষম্য বিলোপে ছাত্র আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ফেনীতেও তীব্র উত্তাপ ছড়াল। খুনিদের বারুদ-বুলেটের গর্জনে মুহূর্তে ফেনীর মহিপালে বয়ে গেল রক্তের হোলি। ৫ আগস্ট স্বদেশ রাহুমুক্ত হল, ৪ আগস্ট তপ্ত দুপুরে রক্তরাঙা সড়কে পড়ে রইল ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণের নিথর দেহ।
৪ আগস্ট ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে অসহযোগের প্রথম দিন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ফেনীর মহিপালে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করছিল ছাত্র-জনতা। শহীদ ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ অন্যান্য দিনের ন্যায় সেদিন সকালে বন্ধুদের সাথে নিয়ে যোগ দেন আন্দোলনে। শ্রাবণের শতীর্থরা জানান, ফেনীতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সে ছিল নিয়মিত মুখ।
অবিরত ক্রন্দনরত নিহত শ্রাবণের মা ফাতেমা আক্তার শিউলি বলেন, আমার ছেলে বলতো, আম্মু এখনি সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার। আমি বারণ করার পরও সে দেশের জন্য প্রতিদিন চলে যেত। আন্দোলনে যাওয়ার সময় আমার একটি ওড়না মাথায় বেঁধে রাখত এবং তার নিজের নাম লেখা একটি জার্সি পরে যেত। তার মামা, বাবা সবাই তাকে বোঝাত কিন্তু সে সবাইকে বলতো, অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে আল্লাহর দরবারে জবাব দিতে হবে।
তিনি বলেন, মারা যাওয়ার আগেরদিন রাতে (৩ আগস্ট) সে একটু অস্থির আচরণ করছিল। রাত তিনটায় উঠে আমার কক্ষে এসে আমাকে ডাকে, কিছু কথা বলে আবার চলে যায়। সে বলে, তার ভাত খেতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু সে খায়নি। তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে এবং পরবর্তীতে ফজরের নামাজ পড়ে সে ঘুমায়। সেটিই আমার সাথে শেষ কথা ছিল।
অশ্রুসিক্ত কন্ঠে তিনি বলেন, আমার শ্রাবণের বন্ধু মাহফুজ তার লাশ নিয়ে এসেছিল। স্থানীয় কিছু মানুষরূপী শয়তান তাড়াহুড়ো করে আমার ছেলেকে দাফন করতে চেয়েছিল। আমি আমার শ্রাবণকে একটু আদর করতে চেয়েছি, তার মুখটা আরও কিছু সময় দেখতে চেয়েছি। তারা সেই সুযোগ আমাকে দেয়নি। আমার ছেলেকে আমার কাছে রাখতে দেয়নি তারা।
ইফরাদ নামে শ্রাবণের এক বাল্যবন্ধু জানান, জীবনে অনেক বন্ধু পাব কিন্তু শ্রাবনের মতো কেউ আমার জীবনে আসবে না।
পরিবার সূত্র জানায়, ১৯ বছর ৭ মাস ১৮ দিন বয়সী শ্রাবণ ছিলেন একজন সংগঠক এবং ক্রিকেটার। সে ন্যাশনাল চিলড্রেন’স টাস্ক ফোর্স (এনসিটিএফ) ফেনী জেলার ২০২১-২২ সালের কমিটির সহসভাপতির দায়িত্বপালন করেন বলে জানান সংগঠনটির সাবেক একজন সভাপতি মোস্তাফিজ মুরাদ। মুরাদ জানান, এর আগে সংগঠনটির একাধিক কমিটিতে সাধারণ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শ্রাবণ। পরবর্তীতে ২০২২ সালের দ্বিবার্ষিক নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বপালন করেছেন। এনসিটিএফ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর গ্রহণ করার পর ইয়েস বাংলাদেশ ফেনী জেলার সক্রিয় সদস্য হিসেবে দায়িত্বপালন করেন৷
ফেনী ক্রিকেট একাডেমির সদস্য ছিলেন শ্রাবণ। একাডেমির প্রধান এবং কোচ রিয়াজ উদ্দিন রবিন জানান, ফেনীতে ক্রিকেট প্রশিক্ষণ একাডেমিগুলোর অংশগ্রহণে আয়োজিত দুইটি টুর্নামেন্টে খেলেছিলেন শ্রাবণ। চারিত্রিক দিক থেকে সে ছিল উদাহরণযোগ্য।
শ্রাবণের বন্ধুরা জানান, গত ৪ আগস্ট সরকার পদত্যাগের একদফা আন্দোলনের অবস্থান কর্মসূচিতে মহিপালে অংশ নেন শ্রাবণ। আনুমানিক দুপুর ২ টার দিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নির্মমভাবে গুলি চালায় শিক্ষার্থীদের ওপর। এসময় একটি গুলি এসে লাগে শ্রাবণের বুকে। সেখান থেকে বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করে ঘরে নিয়ে যায়। এরপর তাকে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। ছাত্র আন্দোলনে ফেনীর প্রথম শহিদ শ্রাবণ। দেশের জন্য নিজের জীবন দিয়ে নতুন করে দেশরক্ষায় ভূমিকা রাখে সে।
পরিবার সূত্র জানায়, নিহত ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ ২০০৪ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ২০২৩ সালে ফেনী সরকারি কলেজ হতে এইচএসসি পাশ করেন। উচ্চশিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলেন। তার বাবার নাম নেছার আহমেদ। বাবা মায়ের সাথে শহরের বারাহীপুরে বসবাস করতেন, পৈত্রিক বাড়ি ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর ইউনিয়নে। তিন ভাইবোনের মধ্যে শ্রাবণ সবার বড় এবং পরিবারের একমাত্র ছেলে।