বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে আজ মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) থেকে ফেনীসহ দেশের পূর্বাঞ্চলে ফের বন্যায় আক্রান্ত হতে পারে। গতকাল সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) বেসরকারি আবহাওয়া পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশ ওয়েদার ওবজারভেশনের (বিডব্লিউওটি) পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, এর প্রভাবে দেশের উপর মৌসুমী অক্ষরেখা প্রবল সক্রিয় থাকতে পারে। ফলে আজ থেকে আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে একটানা ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করা রয়েছে। এর প্রভাবে ফেনীসহ দেশের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকাগুলোতে ফের বন্যা দেখা দিতে পারে বলে বিডব্লিউওটির পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে। একইসাথে বন্যার পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যার ফেনীতে ক্ষতির ছাপ এখনো সর্বত্র। বন্যার কবলে ফেনীর সীমান্তবর্তী ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়াসহ জেলা শহরের প্রায় ৯৫ শতাংশ জায়গা তলিয়ে যায়। সম্প্রতি অক্সফাম প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বন্যায় জেলার ৯০ শতাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে ৪৮ শতাংশ বাড়িঘর। স্মরণকালের এ ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ফেনীর অর্থনীতি, অবকাঠামোসহ শিক্ষাখাত, এর প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক ক্ষেত্রে। ঘরহারা হয়েছেন জেলার অসংখ্য মানুষ। এ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দৈনিক ফেনী।
অক্সফামের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশে আগে দেখা যায়নি। বন্যায় লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ি ও কৃষিজমি ডুবে গেছে। জীবিকা হারিয়েছে লাখ লাখ মানুষ। গবাদিপশুর ক্ষয়ক্ষতি, দুর্গত জনগোষ্ঠীকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
গত ২০ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া বছরের তৃতীয় দফা বন্যার কবলে পড়েন প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অবকাঠামো, বাড়িঘর, কৃষি ও মৎস্য খাত। এসব ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে দুর্গত জনগোষ্ঠীদের জরুরি ও ধারাবাহিক মানবিক সহায়তা প্রয়োজন বলে অক্সফামের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরও দেশে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে। গতকাল আবহাওয়ার ৫ নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে এ বলা হয়েছে, গতকাল দুপুরে ভারতের পুরীর নিকট দিয়ে উড়িষ্যা উপকূল অতিক্রম করে বর্তমানে উড়িষ্যা ও এর পাশ্ববর্তী এলাকায় অবস্থান করছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্র বন্দরসমূহের উপর দিয়ে দমকা-ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে ০৩ (তিন) নম্বর পুনঃ ৩ (তিন) নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলছে আবহাওয়া অফিস। এছাড়া উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারসমূহকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
গতকাল বিকালে বিডব্লিউওটি জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরের গভীর নিম্নচাপটি প্রায় একই শক্তি নিয়ে উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরের কাছ দিয়ে উপকূল অতিক্রম করেছে। ইতোমধ্যে এর প্রভাবে ভারতের উড়িষ্যা ও ছত্রিশগড় রাজ্যে ব্যাপক ভারীবর্ষণ শুরু হয়েছে। এটি ক্রমান্বয়ে উত্তর পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে দূর্বল হতে পারে।
পূর্ব প্রস্তুতিতে যা করণীয়
বন্যা হঠাৎ করে আঘাত হানতে পারে, পরিচিত রাস্তাগুলো কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পরিণত হতে পারে নদীতে। এমন পরিস্থিতিতে প্রস্তুতি এবং সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বন্যার সময় নিরাপদ থাকতে যেসব পূর্ব প্রস্তুতি নিতে পারেন- সবসময় আপডেটেড থাকুন। আবহাওয়া মনিটর করুন এবং স্থানীয় সতর্কতা শুনুন। এমনকি সামান্য নোটিশও আপনাকে প্রস্তুতির সুযোগ দেবে। একটি জরুরি কিট প্রস্তুত রাখুন, যাতে থাকবে পানি, শুকনো খাবার, ওষুধ, ফ্ল্যাশলাইট এবং গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র। কিটটি এমন একটি স্থানে রাখুন যা আপনি সহজেই পেতে পারেন।
যদি আপনাকে এলাকা ছাড়তে হয়, আগে থেকেই পরিকল্পনা করুন। জানুন কোথায় নিরাপদ পথে বের হতে হবে। এই পরিকল্পনাটি পরিবার সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে নিন, যাতে সবাই জানে কী করতে হবে। যদি বন্যার আগে সময় থাকে, বাড়ির কিছু সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন। যেমন ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো উঁচুতে রাখুন, বেসমেন্টের জানালা বন্ধ আছে কি না নিশ্চিত
বন্যা শুরু হলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যখন পানি বাড়তে শুরু করে, তখন তাড়াতাড়ি কাজ করা গুরুত্বপূর্ণ। যদি কর্তৃপক্ষ আপনাকে চলে যেতে বলে, তাড়াতাড়ি নিরাপদ স্থানে চলে যান। বন্যার পানির মধ্য দিয়ে হাঁটা বা গাড়ি চালানোর চেষ্টা করবেন না। বিপজ্জনক হতে পারে।
যদি বাড়ি থেকে বের হতে না পারেন, তাহলে বাড়ির সবচেয়ে উঁচু স্থানে চলে যান। একাধিক তলা বিশিষ্ট ভবনের উপরে উঠুন, তবে সতর্ক থাকুন যেন আটকে না পড়েন। ফোন চার্জ করে রাখুন এবং জরুরি আপডেট শুনুন।
বন্যার পরে সাবধান থাকুন। পানি নেমে গেলেও বিপদ পুরোপুরি দূর হয় না। কর্তৃপক্ষ না বলা পর্যন্ত বাড়িতে ফিরে যাবেন না। বন্যার পানি দুর্বল ভবন, বৈদ্যুতিক সমস্যা এবং দূষণ ছাড়াও আরো অনেক বিপদ বহন করতে পারে। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া এবং রাসায়নিকে দূষিত পানি থেকে দূরে থাকুন। যদি বন্যার পানির সংস্পর্শে আসতে হয়, তাহলে গ্লাভস এবং বুট পরুন। ইউটিলিটি নিয়ে খুব সতর্ক থাকুন। যদি গ্যাস লিক বা বৈদ্যুতিক লাইনে কোনো ক্ষতি দেখতে পান, তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে যান এবং সাহায্য চান।
বন্যা বিপজ্জনক হতে পারে, তবে সঠিক প্রস্তুতি এবং দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ আপনাকে এবং আপনার পরিবারকে নিরাপদ রাখতে সাহায্য করবে। সবসময় নিরাপত্তার দিকে মনোযোগ দিন, আপডেটেড থাকুন, দ্রুত পদক্ষেপ নিন এবং পানি বাড়লে সঠিক কাজটি করুন।