ফেনী জেনারেল হাসপাতালে বেড়েছে রোগীর চাপ। বর্তমানে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে ১০ গুণ রোগীর চাপে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে হাসপাতালটি। ডায়রিয়া ওয়ার্ড, শিশু ওয়ার্ডসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়েছে দশগুণের বেশি।
জানা গেছে, ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সাথে সাথে দেখা দিয়েছে নানা রোগের প্রাদুর্ভাব। ডায়রিয়া, চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, জ্বর ও আমাশয়সহ বিভিন্ন পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত নানা রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। চিকিৎসার আশায় ফেনী জেনারেল হাসপাতালে ভিড় করছেন রোগীরা, ধারণ ক্ষমতার প্রায় ১০গুন বেশি রোগীর সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। শয্যার অভাবে অধিকাংশ রোগীকে হাসপাতালের বারান্দায়, বাইরের রাস্তায়, বাগানের ভেতর বসে সেবা নিতে দেখা গেছে। দুর্যোগ পরবর্তী মানুষের চিকিৎসা সংকট মোকাবেলায় জরুরী ভিত্তিতে অস্থায়ী ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের দাবি রোগীর স্বজন ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের।
সরেজমিনে রোববার (১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ফেনী জেনারেল হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, ওয়ার্ডের ১৭ শয্যার বিপরীতে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১৭০ জন। এখানে কেবল শূন্য থেকে ৩০ বছরের রোগীরা চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। হাসপাতালে অপর একটি ভবনে তদূর্ধ্ব রোগীরা সেবা নিচ্ছেন। সেখানেও ২১ শয্যার বিপরীতে রোগীর সংখ্যা ৭০ জন। ওয়ার্ডের ভেতর বিপুল সংখ্যক রোগীর স্থান না হওয়ায় ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশু রোগীদের নিয়ে ওয়ার্ডের বাইরের রাস্তায় ও বাগানে বিছানা পেতে খোলা আকাশের নিচে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন অভিভাবকরা। একই চিত্র শিশু ওয়ার্ডেও। শিশু ওয়ার্ডে ২৬ শয্যার বিপরীতে রোগীর সংখ্যা ছিল ১৩৬ জন।
ফেনী জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, দিন-দিন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আন্ত:বিভাগ ও বহির্বিভাগে রেকর্ড পরিমাণ রোগী ভিড় করছে। এতে রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স ও মেডিকেল সহকারীরা।
ফেনী সদর উপজেলার বালিগাঁও এলাকা থেকে ডায়রিয়া আক্রান্ত মেয়েকে নিয়ে এসেছেন রাবেয়া আক্তার। এক ঘন্টা অপেক্ষা করার পর নার্সরা স্যালাইন লাগিয়ে গেলেও ভেতরে জায়গা না পেয়ে রাস্তার পাশে মাদুর পেতে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। তিনি বলেন, হাসপাতালে এসেও খোলা আকাশের নিচে বসে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। আমার মতো এমন অসংখ্য মানুষ জায়গা না পেয়ে রাস্তায় ও বাগানে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
ফাইয়াজ ইউশা রাহা নামের এক শিশু রোগীর পিতা মো. রাসেল বলেন, হাসপাতালের ভেতরে চিকিৎসাতো দূরে থাক, দাঁড়ানোর পরিস্থিতিও নাই। এত রোগী আমি আগে কখনও দেখিনি। বাধ্য হয়ে ওয়ার্ডের সামনের বাগানে মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছি। এভাবে চিকিৎসা সেবা হয় না। এ সংকট সমাধানে স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্টদের এখনই উদ্যোগ নেয়া উচিত।
আজাদুর রহমান নামে আরেক রোগীর অভিভাবক বলেন, ডায়রিয়া ওয়ার্ডে শিশু রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। ওয়ার্ডের ভেতরে যতজন রোগী তার থেকে কয়েকগুন বেশি বাইরে খোলা আকাশের নিচে চিকিৎসা নিচ্ছেন। মাত্র ৩/৪ নার্স রোগীদের সেবা দিচ্ছেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও অনেকে সেবা পাচ্ছে না। অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে তারাও হিমশিম খাচ্ছে। যতদ্রুত সম্ভব এখানে নার্স ও চিকিৎসক বাড়ানোর অনুরোধ করছি।
হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স মো. আরিফুর রহমান বলেন, বন্যা পরবর্তী এ সময়ে ডায়রিয়া রোগীর প্রকোপ অনেক বেশি। হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার কয়েকগুণ রোগীর চিকিৎসা স্বল্পসংখ্যক চিকিৎসক নার্স দিয়ে কোনভাবেই সম্ভব না। এর পরও কর্তৃপক্ষ প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এ সংকট নিরসনে কর্তৃপক্ষ যদি আইসিডিডিআরবির সহযোগিতা নিতে পারে এবং এখানে একটি ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করা যায় যায় তাহলে রোগীরা আরও বেশি চিকিৎসা সেবা পাবে।
ডায়রিয়া ওয়ার্ডের ইনচার্জ সবিতা রায় বলেন, শুধুমাত্র গতকালই ৯০ জন রোগী ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছে। যাদের অধিকাংশ শিশু। রোববার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৪০ জন ভর্তি হয়েছে। ওয়ার্ডে ১৭ শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি আছে ১৭০ জন। জনবল কম থাকায় আমাদের খুবই কষ্ট হচ্ছে। রোগীরা কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছে না আমরাও ভোগান্তিতে আছি।
শিশু ওয়ার্ডের ইনচার্জ শ্যামলী রানী বলেন, শিশু ওয়ার্ডে ২৬ শয্যার বিপরীতে রোগী আছে ১৩৬ জন। যে পরিমাণ সে অনুসারে নার্স নেই। বিপুলসংখ্যক রেগীর চাপ সামলাতে আমাদের খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ফেনী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) মোহাম্মদ নাজমুল হাসান সাম্মী বলেন, বন্যা পরবর্তী সময়ে ফেনীতে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বন্যাকালীন দূষিত পানি রোগবাহী আবহাওয়ার কারণেই এমনটি হচ্ছে। অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে আমরা ২১ শয্যার আলাদা ডায়রিয়া ওয়ার্ড চালু করেছি। এরপরও আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ডায়রিয়া রোগীদের জন্য দুটি ওয়ার্ড ও শিশু ওয়ার্ড মিলিয়ে ভর্তি রোগী প্রায় সাড়ে তিন শতাধিক। বিপুলসংখ্যক রোগীদের স্বল্প পরিসরে সেবা দেওয়া আমাদের খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এ কারণেই মূলত রোগীরা কেউ ফ্লোরে কেউ বাইরে অবস্থান করে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, আমরা আমাদের উর্ধ্বতন কর্মকতাদের বিষয়টি অবহিত করেছি, তাদের সহযোগিতা চেয়েছি। ইতোমধ্যে কয়েকটি এনজিও আমাদের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আশা প্রকাশ করেছেন। আমরা তাদের বলেছি দুর্যোগ পরবর্তী এসময়টায় যদি ফিল্ড হাসপাতাল (তাঁবুর তৈরী অস্থায়ী হাসপাতাল) করা গেলে রোগীরদের নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিতে পারবো।