জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যুবদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে সরকারি-বেসরকারি নানা প্রশিক্ষণ চালু থাকলেও যুব দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে রয়েছে জেলা শহর ফেনী। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, সমাজসেবা অধিদপ্তর সহ সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার যুবক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলেও আশানুরূপ কাজে আসছে না এসব প্রশিক্ষণ। বরং প্রশিক্ষিত এইসব যুবকদের বৃহৎ একটি অংশ অদক্ষ হিসেবেই পাড়ি জমাচ্ছেন প্রবাসে। ফলে জেলার বিভিন্ন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ থাকলেও তা কাজে লাগাচ্ছে ফেনীর বাইরে থেকে আসা ব্যক্তিরা।

ফেনীর যুবকরা দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে থাকার কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর প্রশিক্ষণের অভাব, প্রশিক্ষণার্থীর আয় নিয়ে উচ্চাকাক্সক্ষা, স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করতে অনীহা ও পারিপার্শ্বিক অসহযোগিতা অন্যতম কারণ। ২০২২ সালের জনশুমারীর তথ্যে দেখা গেছে, জেলার ১৫-২৪ বছর বয়সীদের ৩৬ শতাংশ কোন কাজই করেন না। অর্থাৎ এরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যান না, অর্থোপার্জনমুখী কোন কাজে সম্পৃক্ত নন।

এ বিষয়ে দৈনিক ফেনীর সাথে আলাপকালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ফেনীর সহকারী পরিচালক আহাম্মদ কবীর জানান, ফেনীর মোট জনসংখ্যার ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ মানুষ প্রবাসী। যা সংখ্যায় দেড় লাখেরও বেশি। স্বাভাবিকভাবে এখানে বিদেশগমণের প্রবণতা বেশি।

যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আরও বলেন, যুবদের প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে যে বিষয় লক্ষ্য করা গেছে তা হল এ অঞ্চলের মানুষ সময় নিয়ে কোন কাজ শিখতে খুব কম আগ্রহ দেখান। আবার যারা কাজ শেখা পর্যন্ত সময় দেন তারাও ওই কাজ নিয়ে জীবন গড়তে চান না। অনেকে পূঁজি সংকটের কারণে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি বা নিজ উদ্যোগে কিছু করতে চান না। যদিও সরকার উদ্যোক্তাদের সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন ঋণ-প্রণোদনা দিয়ে থাকে।

এ কর্মকর্তা আরও বলেন, যুব দক্ষতা বৃদ্ধিতে জেলার ৬ উপজেলায় ৫টি বিষয়ে ৩ হাজার ৪৬৮ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ২০২৩-২৪ বছরে ৩৩৩ জন যুবককে ১ কোটি ৫৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া কর্মসংস্থান ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক থেকেও প্রশিক্ষণার্থীরা চাইলে ঋণ নিতে পারেন। মূলত তারা দেশে সন্তোষজনক আয় করতে পারেন না বলেই প্রবাসের দিকে ঝুঁকছেন। এজন্যই জেলায় কাজের ক্ষেত্র থাকলেও স্থানীয় জনগণ হতে কর্মী পাওয়া যায় না।

একই ব্যাপারে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ফেনীর উপপরিচালক নাসরীন আক্তার বলেন, পুরুষের তুলনায় নারীদের ঘরের বাইরে কাজের সুযোগ অনেক কম। তবুও নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতি বছর ৪০০ জন নারীকে ৫টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া সোনাগাজী ও দাগনভূঞায় বছরে ২৪০ জন সেলাই প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন। এছাড়া নারীদের স্বাবলম্বী করণে ক্ষুদ্র ঋণের আওতায় ২৫২ জনকে ঋণ প্রদান করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের কর্মবিমুখ ৩৬ শতাংশের মধ্যে ৮৫ শতাংশই নারী।

সমাজসেবা অধিদপ্তর ফেনীর উপপরিচালক সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, যুব দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ, উপজেলা পর্যায়ে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ, সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তর মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণসহ নানা কার্যক্রম করে থাকে সমাজসেবা অধিদপ্তর।

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ফেনীর তথ্যমতে, প্রশিক্ষণে পুরোনো উপকরণ ব্যবহার ও সনাতন পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ কর্মশালা পরিচালিত হওয়ায় এসব প্রশিক্ষণে যুবদের আগ্রহ যেমন কম রয়েছে, তেমনি প্রয়োজনের তুলনায় প্রশিক্ষক ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ উপকরণের সংকট রয়েছে।

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ফেনীর সহকারী পরিচালক সাইফ উদ্দিন আহমেদ জানান, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। সে জন্য পর্যাপ্ত জনবল, যন্ত্রপাতি বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন।

ফেনী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) কর্তৃক পরিচালিত স্কিল-২১ সাবেক প্রোগ্রাম কোর্ডিনেটর সামিয়া মাহবিন মনে করেন, যুবকদের দক্ষতা অর্জনে উন্নতমানের আধুনিক প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। প্রশিক্ষণ শেষে কাজের নিশ্চয়তা পেলে যুবকরা এ বিষয়ে আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠবে বলে মনে করেন তিনি।

ফেনী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মেকানিক্যাল টেকনোলজির শিক্ষক হযরত আলী বলেন, বাস্তব শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের প্রতি তরুণ বা যুবকদের আগ্রহ হতাশাজনক। পৃথিবীর যতগুলো দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে গেছে তারা সকলেই বাস্তবমুখী শিক্ষার প্রতি শতভাগ গুরুত্বারোপ করে এগিয়েছে। অথচ আমাদের দেশের মানুষ এখনও কারিগরি বা বাস্তবমুখী শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করছে না। তরুণ ও যুবরা বাস্তবমুখী শিক্ষা অর্জনে ব্যর্থ বলেই দক্ষতা প্রমাণে ব্যর্থ হচ্ছে।

২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ সভায় প্রতি বছর জুলাই মাসের ১৫ তারিখকে ‘বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস’ হিসেবে উদযাপন করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এরই প্রেক্ষিতে প্রতিবছর ১৫ জুলাই সারাবিশ্বে দিবসটি উদযাপন করা হচ্ছে। জাতিসংঘ ঘোষিত এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য বিশ্বের তরুণদের বিভিন্ন দক্ষতায় দক্ষ হয়ে ওঠার আহ্বান জানানো এবং ভবিষ্যতের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষ যুবকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরা।