ফেনীর আলোচিত নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় ১৬ জনের মৃত্যুদন্ড দিয়েছে আদালত। বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর)সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মামুনুর রশিদ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৪(১)/৩০ ধারায় এ রায় ঘোষণা করেন।
বিচারক সকাল ১১:১৫ টায় মানবতা বিরোধী কর্মকান্ড আখ্যায়িত করে এ রায় পাঠ শুরু করেন। রায়ে মামলার প্রধান আসামী সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা হত্যাকান্ডের প্রধান পরিকল্পনাকারী, হত্যায় সরাসরি অংশগ্রহণের দায়ে নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, সাইফুর রহমান, মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, হাফেজ আবদুল কাদের, আবছার উদ্দিন, কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা, আবদুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন ওরফে মামুন, মোহাম্মদ শামীম, রুহুল আমীন ও মহিউদ্দিন শাকিলকে আমৃত্যু ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের রায় ঘোষনা করেন। এছাড়া প্রত্যেকের ১ লক্ষ টাকা করে নুসরাতের পরিবারকে ক্ষতিপূরন হিসেবে প্রদানের জন্য রায়ে নির্দেশ দেয়া হয়। রায় শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সিরাজ উদ্দৌলাসহ দন্ডপ্রাপ্ত আসামীরা। দন্ডপ্রাপ্ত আবছার উদ্দিন আল্লাহ বিচার করবে বলে আহাজারি করতে থাকে।
ক্ষমার অযোগ্য সিরাজ:
গত ২৭ মার্চ নুসরাতকে শ্নীলতাহানি করেন অধ্যক্ষ সিরাজ। ওই দিন মামলা দায়েরের পর গ্রেপ্তার হন তিনি। ২৮ মার্চ সিরাজকে কারাগারে পাঠানো হয়। পরদিন ফেনীর জেলখানায় গিয়ে সিরাজের সঙ্গে দেখা করেন এ মামলার আসামি নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, আবদুল কাদের, জাবেদ, রানা, অধ্যক্ষের স্ত্রীসহ সাতজন।
গত ১ এপ্রিল জেলখানায় অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করে শামীম, নূর উদ্দিনসহ পাঁচজন। ওই দিন ডিসি ও এসপির কাছে অধ্যক্ষের পক্ষে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। ৩ এপ্রিল আবার ফেনীর জেলখানায় প্রিন্সিপালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ১৫ জন। ৪ এপ্রিল বিকেলে মাদ্রাসার দক্ষিণ পাশের টিনশেড ভবনের পাশে অধ্যক্ষের পক্ষে প্রথম বৈঠক হয়। সেখানে নূর উদ্দিন, জোবায়েরহ ছয়জন উপস্থিত ছিল। দ্বিতীয় বৈঠক হয় সন্ধ্যা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। ওই বৈঠকে ২০ সদস্যের মুক্তি পরিষদ গঠন হয়। দ্বিতীয় দফার বৈঠকে উপস্থিত ছিল ১৬ জন।
৪ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত মাদ্রাসার পশ্চিম পাশের তৃতীয় তলার ছাত্র হোস্টেলে তৃতীয় দফায় বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিল নূর উদ্দিন, শামীম, জোবায়ের, কাদেরসহ ১০ জন। হত্যায় ব্যবহূত সরঞ্জাম কেনায় অর্থ দেয় কাউন্সিলর মাকসুদ আলম। কেরোসিন কেনে শামীম, বোরকা ও হাতমোজা কিনেছে কামরুন্নাহার মনি। এর আগে উম্মে সুলতানা পপির মাধ্যমে শামীমের কাছ থেকে দুই হাজার টাকা পায় মনি। ৬ এপ্রিল বান্ধবী নিশাতকে মারধর করা হচ্ছে বলে ছাদে নুসরাতকে ডেকে নিয়ে গায়ে আগুন দেওয়া হয়। একটি গ্রুপ এ কাজে নিয়োজিত ছিল। আরেকটি গ্রুপ মাদ্রাসার সাইক্লোন শেল্টার ও গেট পাহারায় ছিল। ১০ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢামেক বার্ন ইউনিটে মারা যান নুসরাত।
গত ২৯ মে ১৬ জনকে আসামি করে নুসরাত হত্যা মামলার চার্জশিট দাখিল করে পিবিআই। ১০ জুন আদালত মামলাটি আমলে নিলে শুনানি শুরু হয়। ২০ জুন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়। এ মামলায় মোট সাক্ষ্য দিয়েছেন ৮৭ জন। নুসরাত হত্যার পর বেরিয়ে আসে এসপি, এডিএম (অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট) ও ওসির বিতর্কিত ভূমিকার কথা। নুসরাতের পরিবারও বলে আসছে, প্রশাসনের লোকজন দায়িত্বশীল আচরণ করলে হয়তো নুসরাতকে ওই পরিণতি বহন করতে হতো না।
আসামি যারা:
নুসরাত হত্যার ঘটনায় পরিকল্পনা, অর্থ সহায়তা, প্রশাসনকে ম্যানেজ করার দায়িত্বসহ নানাভাবে ভয়ংকর এই ছকে ১৬ জনের সংশ্নিষ্টতার তথ্য পেয়েছে পিবিআই। তাদের সবাইকে বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়।
হত্যায় কার কী ভূমিকা :
৬ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৭টার দিকে শামীম, নূর উদ্দিন, আবদুল কাদের মাদ্রাসার সামনে যায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী অন্যরা সকাল ৮টা থেকে ৯টা ২০ মিনিটের মধ্যে যার যার অবস্থানে চলে যায়। শামীমের পলিথিনে নিয়ে আসা কেরোসিন তেল ও অধ্যক্ষের সামনের কক্ষ থেকে একটি কাচের গ্লাস নিয়ে ছাদের বাথরুমের পাশে রেখে দেয়। কামরুন্নাহার মনির কেনা দুটি ও বাড়ি থেকে আনা একটিসহ মোট তিনটি বোরকা ও চার জোড়া হাতমোজা সাইক্লোন শেল্টারের তিনতলায় নিয়ে রাখা হয়। শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের সাড়ে ৯টার দিকে বোরকা ও হাতমোজা পরিহিত অবস্থায় তৃতীয় তলায় অবস্থান নেয়।
নুসরাত পরীক্ষা দিতে গেলে পপি নুসরাতকে জানায়, তার বান্ধবী নিশাতকে ছাদে মারধর করা হচ্ছে। এর পর নুসরাত দৌড়ে ছাদে যেতে থাকে। নুসরাত সেখানে পৌঁছলে পপি নুসরাতকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে বলে। নুসরাত মামলা তুলবে না জানালে পপির সঙ্গে ছাদে উঠতে থাকলে কামরুন্নাহার মনি, শামীম, জোবায়ের ও জাবেদ তাদের পেছনে পেছনে সেখানে যায়। সেখানে নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে হুমকি প্রদান করে একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিতে বলে। তিনি মামলা তুলতে রাজি না হওয়ায় তারা ক্ষিপ্ত হয়। এরপর শামীম বাঁ হাত দিয়ে নুসরাতের মুখ চেপে ধরে এবং ডান হাত দিয়ে নুসরাতের হাত পেছন দিকে নিয়ে আসে।
পপি নুসরাতের গায়ের ওড়না খুলে জোবায়েরকে দিলে জোবায়ের ওড়না দু'ভাগ করে ফেলে। ওড়নার এক অংশ দিয়ে পপি ও মনি নুসরাতের হাত পেছনে বেঁধে ফেলে; অন্য অংশ দিয়ে জোবায়ের নুসরাতের পা পেঁচিয়ে ফেলে। আসামি জাবেদ পায়ে গিঁট দেয়। সবাই মিলে নুসরাতকে ছাদের ফ্লোরে ফেলে দেয়। শামীম নুসরাতের মুখ ও গলা চেপে রাখে। মনি নুসরাতের বুকের ওপর চাপ দিয়ে ধরে এবং পপি ও জোবায়ের পা চেপে ধরে। জাবেদ পাশের বাথরুমে লুকানো কেরোসিনের পলিথিন থেকে কাচের গ্লাসে কেরোসিন নিয়ে নুসরাতের পুরো গায়ে ঢেলে দেয়। শাহাদাতের ইশারায় জোবায়ের ম্যাচ দিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। মহিউদ্দীন শাকিল ও মোহাম্মদ শামীম সাইক্লোন শেল্টারের দুই সিঁড়ির সামনে পাহারারত ছিল। মাদ্রাসার মূল গেটের পাশে ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, আবদুর রহিম শরীফ ও হাফেজ আবদুল কাদের পাহারায় ছিল। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার পর আসামিরা নিরাপদ স্থানে সরে গিয়ে ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে বিভিন্নভাবে প্রচার চালায়।