ফেনীতে ফের শুরু হয়েছে কৃষি জমির টপ সয়েল (জমির উপরিভাগের ৬ হতে ৭ ইঞ্চি) কর্তন। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন টপ সয়েল কেটে মাটি বিক্রি করার প্রবণতা কৃষির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। এতে কমে যাবে আবাদী জমির উৎপাদনশীলতা। ফলে অধিক চাষাবাদেও ফলন হবে কম।
বছরের শুরুতেই অভিযোগ এসেছে ফেনী সদরের ফরহাদনগর ও ফুলগাজীর সদর ইউনিয়নের বৈরাগপুর, ঘনিয়ামোড়া, মুন্সিরহাট ইউনিয়নের তারালিয়া, নোয়াপুর, বদরপুর, কতুবপুর, জিএমহাট ইউনিয়নের নুরপুর, শরীফপুর, আমজাদ ইউনিয়নসহ সোনাগাজী ও ছাগলনাইয়াতেও আবাদী জমি হতে টপ সয়েল কাটা শুরু হয়েছে। শুধু কৃষি জমি নয়, অভিযোগ রয়েছে সদরের ধর্মপুর ইউনিয়নে টিলা কেটে মাটি চুরির ঘটনা ঘটছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন মাটি কাটা হয় রাতের অন্ধকারে। কারা কাটছে তা প্রত্যক্ষদর্শীরা জানলেও ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না।
সোনাগাজীর সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ জাকির হোসেন বলেন, সম্প্রতি চরদরবেশ ইউনিয়নে ফসলী জমির মাটি কাটার দায়ে ইউনিয়ন পরিষদ স্থানীয় সরকার আইনে ৩টি মামলা করা হয় এবং ৪৩ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
ছাগলনাইয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাজিয়া তাহের দৈনিক ফেনী’কে জানান, এবার শীত মৌসুমে ছাগলনাইয়াতে মাটি কাটার বিষয়ে তিনটি অভিযোগ পেয়েছি এবং সাথে সাথে ঘটনাস্থলে গিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
আবাদী জমির উপরিভাগ কেটে ফেলার ক্ষতি প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ ফেনীর উপ-পরিচালক তোফায়েল আহমেদ চৌধুরী বলেন, প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে মাটি সবচেয়ে মূল্যবান। উপরিভাগের ৬ হতে ৭ ইঞ্চিতেই থাকেই সব ধরনের জৈব গুনাগুণ এবং উৎপাদনশীলতা। অথচ কেটে ফেলা হচ্ছে ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি মাটি। ফলে জমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে আশংকাজনক হারে। একবার টপ সয়েল কেটে নিলে তা পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে এক যুগ সময় লাগে। এতে সহজে অনুমেয় ক্ষতির পরিমাণ কতটা প্রকট।
ফেনী সরকারি কলেজের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের প্রভাষক আহমদ আলী বিভোর বলেন, মাটির সবচেয়ে উপরের স্তর টপ সয়েলে সবচেয়ে বেশী ঘণত্বের জৈবিক বস্তুু থাকে বলে উদ্ভিদ পৃথিবীর প্রায় ৯৫ শতাংশ খাদ্য উৎপাদনে একে সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করে। তিনি বলেন, গত ১৫০ বছরে টপ সয়েলের প্রায় ৫০ শতাংশই নষ্ট হয়ে গেছে। প্রাকৃতিকভাবে এর পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চলতে থাকলেও তা ধীরগতি সম্পন্ন।
আইন বহির্ভূত কর্মকান্ড ঠেকাতে বছর জুড়ে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের জেএম শাখার দায়িত্বে সহকারি কমিশনার মোঃ মনিরুজ্জামান জানান, অবৈধ বালু উত্তোলন ও আবাদী জমির মাটি কর্তন রোধে ২০২০ সালে ৬০টি অভিযান পরিচালনা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে ১০৫টি মামলা করা হয় এবং ৪৬ লাখ ৪৯ হাজার ২শ টাকা জরিমানা করা হয়।
জেএম শাখা সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালে ফেনী সদর উপজেলায় সর্বোচ্চ ১৬টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মোঃ ওয়াহিদুজজামান দৈনিক ফেনীকে বলেন, জেলায় একশোর বেশি ইটভাটা রয়েছে। যা প্রতি ইউনিয়নে গড়ে তিনটির মত। মাটি মূলত ইটভাটাতেই প্রয়োজন। পুকুর, আবাদ অযোগ্য জমি হতে মাটি নেয়ার অনুমতি রয়েছে। তবে কোনভাবে আবাদী জমির টপ সয়েল কাটা আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। নীতিমালা অমান্য করলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, অনেক সময় মাটি কেটে নেবার ফলে ফসলি জমি নষ্ট হবার পাশাপাশি পাশের জমিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে সভা করে ইটভাটা মালিকদের বিষয়গুলো অবহিত করা হয়েছে। নীতিমালার বাইরে কেউ গেলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
টপ সয়েল বিক্রির করতে ভূমি মালিকদের নানাভাবে প্ররোচিত করছে ব্যবসায়ীরা। মাটি বিক্রি করা এক ভূমি মালিকের সাথে কথা বলে জানা যায়, ব্যবসায়ীরা তাদের মাটি বেচার ব্যাপারে উৎসাহিত করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ভূমি মালিক জানান, মাটি ক্রেতারা বলছে টপ সয়েল কাটলে জমির কোন ক্ষতি হবে না। এক বছরের মধ্যেই বর্ষা এলে জমির সেই মাটি পূরণ হয়ে ফসল ফলানো যাবে।
মাটি কাটার ব্যাপারে জানতে গতবছরে এ সময়ে বক্সমাহমুদের কেবিএম ব্রিক ফিল্ডের মালিক মোশাররফকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, আমরা গাড়ি হিসেবে মাটি কিনি। সরাসরি কোন ভূমি মালিক হতে মাটি কিনি না। তিনি বলেন, প্রশাসনের অনুমতিক্রমে আমরা পুকুর হতে মাটি কাটছি।
ফেনী জেলা ট্রাক, কভার্ডভ্যান ও পিকআপ পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা জানান, জমির মালিক টাকার প্রয়োজনেই মাটি বিক্রি করছে। তারা নিজেরাই মাটি ব্যবসায়ীদের খবর দিচ্ছেন।