মহাকালের আর্বতে বিলীন হয়ে গেল আরও একটি বছর। বিদায় নিলেও ২০২০ সালটা নানা অঘটনের বছর হিসেবে ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে রবে। করোনা আতঙ্কে বিধ্বস্ত মাদনুষ এই বছরে হারিয়েছেন অনেক কিছু। অপ্রাপ্তির ভাঁড়ার হয়তো উপচে পড়ছে বিশ সালে। বছর জুড়ে লকডাউন, সামাজিক দুরুত্ব, হাতধোয়া, মাস্ক পরা, শ^াসকষ্ট, নেগেটিভ আর পজিটিভ নিয়ে তটস্থ ছিল সাধারণ মানুষ। আর বিষাদময় মৃত্যুর ঘটনাগুলো ছাপ রেখে গেছে এখানে-ওখানে। আবার নৃশংস হত্যা, ধর্ষণ, বন্যা, আত্মহত্যাসহ নানা ঘটনায় ২০২০ সাল জুড়ে জেলা শহর ফেনী ছিল কখনো আলোচিত, কখনো আন্দোলিত, কখনো বিক্ষুব্ধ, কখনো শোকে ম্লান। এক পলকে বছর জুড়ে সেইসব ঘটনাবহুল দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করতে দৈনিক ফেনীর এই ধারাবাহিক আয়োজনের আজকের দ্বিতীয় পর্ব। এ পর্বে গত বছরে ফেনীতে ঘটে যাওয়া আলোচিত হত্যাকান্ড সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে, যা জনমনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
ফেইসবুক লাইভে এসে স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যা
বৈশ্বিক মহামারীর বিপর্যয়ময় পরিস্থিতিতে ঘটনাটি আলোড়ন তুলেছিল সারাদেশে। বিদায়ী বছরের ১৫ এপ্রিল দুপুরে ফেনী শহরের বারাহীপুরে এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। ওইদিন দাম্পত্য কলহের জের ধরে ফেইসবুক লাইভে এসে স্ত্রী তাহমিনাকে কুপিয়ে হত্যার করে স্বামী ওবায়েদুল হক টুটুল। ঘটনাটি সারাদেশে আলোড়ন তৈরি করেছিল। মেয়েকে হত্যার অভিযোগ এনে টুটুলের বিরুদ্ধে ফেনী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন নিহত তাহমিনার পিতা সাহাবউদ্দিন। পুলিশ ঘটনার দিনই টুটুলকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে।
টুটুল ও তাহমিনা প্রেমের সম্পর্ক গড়িয়েছিল বিয়েতে। পাঁচ বছর সেই সম্পর্ক টিকেছিল। তাদের কোলজুড়ে এসেছিল এক কন্যা সন্তান। তাহমিনার পরিবারে দাবি, যৌতুকের দাবি মেটাতে না পারায় ক্ষিপ্ত হয়ে তাহমিনাকে হত্যা করেছে টুটুল। এত টুটুলের পরিবারের সদস্যরাও জড়িত রয়েছে। মেয়ের হত্যাকান্ড বাবা সাহাবউদ্দিন বলেন, টুটুল যেভাবে তার মা, বোন, ভাইকে আলাদা কক্ষে বেঁধে রেখে তাহমিনাকে হত্যা করেছে তা অবিশ্বাস্য।
স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় টুটুল আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করেছে।
পুত্রবধূর পরকীয়ার বলি শাশুড়ী
ফুলগাজীর আনন্দপুর ইউয়িনরে নিজ বাড়ী থেকে গত ১৭ জুন নিখোঁজ হয়েছিলেন অসুস্থ এক বৃদ্ধা মহিলা ছেমনা আক্তার (৭৩)। নিখোঁজের ৯ দিন পর ২৬ জুন বাড়ির পাশে একটি ডোবা থেকে অর্ধগলিত অবস্থায় ওই মহিলার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বৃদ্ধা ছেমনার ছোট ছেলে মোশারফ হোসেন সুফল অভিযোগ করেন, লিবিয়া প্রবাসী তার মেঝভাইয়ের স্ত্রী রাশেদা আক্তারের পরকীয়ার বলী হয়ে হয়েছেন তার মা।
এ ঘটনায় সুফল বাদী হয়ে তার মেঝ ভাইয়ের স্ত্রী রাশেদা আক্তার (২৫) এর নাম উল্লেখ করে আরো ৫/৬ জনকে অজ্ঞাত আসামী করে ফুলগাজী থানায় মামলা দায়ের করেন। পুলিশ মামলায় অভিযুক্ত প্রধান আসামী রাশেদা আক্তারকে শুক্রবার রাতে খিলপাড়া গ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করেছেন।
ছনুয়ায় ডাকাতের হামলায় বৃদ্ধার মৃত্যু
গত ৯ জুলাই মধ্যরাতে ফেনী সদরের ছনুয়া ইউনিয়নের পশ্চিম ছনুয়া গ্রামের রেহান উদ্দিন ভূঞা বাড়িতে হানা দেয় ৪ জনের একটি ডাকাত দল। ঘরে প্রবেশ করে ডাকাতরা ওই বাড়ির বৃদ্ধা ও দুই গৃহবধুকে গামছা দিয়ে হাত পা বেঁধে ঘরের একটি কক্ষে আটকে রাখে। একপর্যায়ে শৌরচিৎকার শুরু করলে ডাকাতদের হামলায় ঘটনাস্থলে মারা যান বৃদ্ধা ছকিনা বেগম (৮০)। পরে ডাকাতরা তার সাথে থাকা দুজনকে শ্লীলতাহানি করে ৪ ভরি স্বর্ণ, নগদ ১০ হাজার টাকাসহ প্রায় ৮ লাখ টাকার মালামাল লুট করে পালিয়ে যায়।
এ ঘটনায় ওই বৃদ্ধার ছেলে আশরাফুল ইসলাম বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। তদন্ত করে এ ঘটনায় জড়িত থাকায় ৪ ডাকাতকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে একজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছে।
সেফটিক ট্যাংকে প্রকৌশলীর লাশ
বছরের শেষ দিকে এসে পুরো ফেনী জুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল ঘটনাটি। গেল বছরের ১০ অক্টোবর রাতে ফেনী শহরের পুরাতন রেজিস্ট্রি অফিসের মনির উদ্দিন সড়কের তাসপিয়া ভবনের সেপটিক ট্যাংকের ভেতর হতে মোঃ ইউনুস বাবু (২২) নামে আরেক যুবকের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বাবু চীনের আহোট ইউনিভার্সিটিতে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করতো। তিনি শহরের শাহীন একাডেমী সড়কের একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। তার গ্রামের বাড়ি সোনাগাজীর তাকিয়া বাজারের পাইকপাড়ার সওদাগর বাড়ি। এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় আরও একবার আলোড়িত হয়েছিল ফেনী।
ঘটনার আগের দিন একই স্থান হতে গুরুতর আহতাবস্থায় মোঃ শাহরিয়ার নামে অপর এক যুবককে উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ভবনের কেয়ারটেকার মোজাম্মেল হক শাহিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ঘটনায় বাবুর মা রেজিয়া বেগম বাদী হয়ে তারই বন্ধু ইউনুছ নবী রাকিব ও কেয়ারটেকার শাহীনসহ ৪ হতে ৫ হন অজ্ঞাতনামা আসামী বিরুদ্ধে ফেনী মডেল থানায় হত্য মামলা করেন। এ মামলায় দুই দফায় শাহীনকে ৯ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। বাবু হত্যার দায় স্বীকার করেছে আদালতে ১৬৪ ধারায় শাহীনের জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়েছে।
বালু মহাল নিয়ে দ্বন্দ্বের বলি সিএনজি চালক
১৪ অক্টোবর ছাগলনাইয়ায় বালু নিয়ে আধিপত্য বিস্তারে দাউদ-ফারুক ও ডলফিন গ্রুপের দ্বন্দ্বের বলি হন মোঃ জামশেদ আলম (১৯) নামে এক সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক। নিহতের বাবা দিল মোহাম্মদের অভিযোগ, স্থানীয় দাউদ-ফারুক গ্রুপের হামলায় নিহত হয় জামশেদ। তিনি জানান, আহত জামশেদকে ১৫ অক্টোবর ভোরের দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেবার পথে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় একই এলাকার হাসান (১৮) ও রিয়াদ (১৮) নামে দুই যুবক আহত হয়েছে। তারা ডলফিন গ্রুপের সদস্য।
এ ঘটনায় নিহতের বাবা বাদী হয়ে ৮জনকে আসামী করে থানায় মামলা দায়ের করেন। গত ২৫ অক্টোবর এ হত্যা মামলার আসামী অহিদুর রহমানকে (২১) গ্রেফতার করে ছাগলনাইয়া থানা পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছাগলনাইয়া থানার উপ পরিদর্শক মোঃ নাঈম উদ্দিন জানান, গ্রেফতারকৃত অহিদুর রহমান ছাড়া বাকী আসামীরা সবাই পলাতক রয়েছে। তাদের গ্রেফতার করতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।
কাজীরবাগে শিপনের চোখ উপড়ানো লাশ
গত বছরের ১৮ অক্টোবর ফেনী সদরের কাজীরবাগ ইউনিয়নের পূর্ব রুহিতিয়া গ্রামের পাটোয়ারী বাড়ি সংলগ্ন পরিত্যক্ত একটি পরিত্যক্ত টয়লেটের পেছন থেকে সালমান হোসেন শিপন (২৫) নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার দুহাতের রগ কাটা ছিল, এছাড়া বাম চোখ ছিল উপড়ানো। তার পুরুষাঙ্গেও আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। শিপন ঢাকায় স্যানিটারি মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করত। ঘটনার আগের দিন সে বাড়িতে আসে।
এ ঘটনার পরদিন নিহতের শিপনের মা সেলিনা আক্তার বাদী হয়ে সাত জনের নামোল্লেখে ও একাধিক অজ্ঞাতনামা আসামীর বিরুদ্ধে ফেনী মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন। তবে ঘটনার প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এ মামলার প্রধান আসামী আবদুল কাদেরকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ফেনী মডেল থানার উপপরিদর্শক মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, এ মামলায় নিহতের প্রেমিকা সুমি, সুমির বাবা হাশেম এবং বন্ধু তৌহিদ আটক রয়েছে। মামলার প্রধান আসামী আবদুল কাদের আত্মগোপনে রয়েছে। তাকে আমরা খুঁজছি। সে গ্রেফতার হলে এ হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটনের সম্ভাবনা রয়েছে।
একদিকে সন্তান হারানো বেদনা, অন্যদিকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে চারদিকে অন্ধকার দেখছেন মা সেলিনা আক্তার।
রামপুরে গৃহবধূর লাশ উদ্ধার
বছরের শেষ দিকে এসে আরও একটি ঘটনা নাড়া দিয়েছিল ফেনীকে। গত ১৭ ডিসেম্বর বিকালে ফেনী শহরের রামপুর তনু পাটোয়ারী বাড়ীতে শ^শুরালয়ে মাহমুদা আক্তার শিরিন (২৩) নামে এক গৃহবধূর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। মাহমুদার স্বজনদের দাবি, স্বামী এবং শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। মাহমুদা দাগনভূঞার রাজাপুর ইউনিয়নের পশ্চিম রামচন্দ্রপুরের ছলু ভূঁঞা বাড়ির অহিদুর রহমান ও আলেয়া বেগমের মেজ মেয়ে। একইদিন রাত ১০টার দিকে খবর পেয়ে পুলিশ ওই গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করে।
এ ঘটনায় নিহতের বাবা অহিদুর রহমান বাদি হয়ে পাঁচজনের বিরুদ্ধে ফেনী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। আসামীরা হল স্বামী শাহজালাল শাহীন (৩০), ভাসুর বেলাল হোসেন (৪০), ননদ বিবি খাদেজা মায়া (৩৫), শ^াশুড়ী ছালেহা বেগম (৫৫), জা সুমি আক্তার (২০)। এ মামলার প্রধান আসামী শাহজালাল শাহীনসহ এখনও পলাতক রয়েছে।
পাঁচ আসামীর মধ্যে নিহত মাহমুদার শাশুড়ি, ভাসুর বেলাল হোসেন ও জা সুমি আক্তারকে আটক করা হয়েছে। দ্রুততর সময়ে আসামী শাহজালাল শাহীনকে খুঁজে বের করা হবে জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফেনী মডেল থানার উপপরিদর্শক মশিউর রহমান।
বিয়ের ১০ মাস না পেরোতেই মাহমুদার মৃত্যুর ঘটনায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে ফেনী ও দাগনভূঞায়। এ ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবীতে মানববন্ধন করে পরিবারের সদস্য, এলাকাবাসী, শিক্ষক ও সহপাঠীরা। তারা শাহজালাল শাহীনসহ জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে শাস্তি নিশ্চিত করার দাবী জানান।