প্রাণঘাতি মহামারী করোনাভাইরাসের কবলে বিপর্যস্ত পুরো পৃথিবী। এ ভয়াল অণুজীবের কবলে পড়ে সারাবিশ্বে দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। এর আক্রমণে জেলা শহর ফেনীতেও নেমে এসেছে শোকের কালো মেঘ। একে একে ফেনী হারাতে থাকে তার কীর্তিমান সন্তানদের। তাদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক, শিল্পী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবি, কেউ বা অন্য পেশার। কিন্তু তাঁরা নিজ কর্মে ও গুণে সমাদৃত ছিলেন পুরো জেলা জুড়ে। হারিয়ে গেলেও তাদের চিন্তা, চেতনা ও কর্মে আমাদের অণুপ্রেরণার উৎসস্থল হয়ে বিরাজ করবেন চিরকাল।
আজ শনিবার (১৯ সেপ্টম্বর) বিকালে ফেনীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্ত্বরে ফেনীর প্রয়াত কীর্তিমানদের স্মরণে সামাজিক সংগঠন আমরা ভালোর সঙ্গে ‘আ ভা স’ আয়োজিত ‘নাগরিক শোক’ সভায় এভাবেই নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন বক্তারা। একইসাথে শোক বইতে লিখেছেন তাদের হারানোর ব্যথা।
জেলা প্রশাসক মোঃ ওয়াহিদুজজামান শোকবইতে লিখেন, ‘যাদের হারিয়েছি তাদের ফিরে পাব না। তাদেরকে আমরা স্মরণে রাখব শ্রদ্ধায় ও কর্মে। তাদের কর্ম আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাবে। দেশ ও জাতির সেবায় তারা যে অবদান রেখেছেন তা আমরা কখনো ভুলবোনা। আমি সকলের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। আয়োজকদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। জেলা প্রশাসন আপনাদের সাথে সবসময় থাকবে।’
সিভিল সার্জন ডাঃ মীর মোবারক হোসেন দিগন্ত জেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। এসময় করোনাকালীন সময়ে ফেনীর স্বাস্থ্য সেবা সমুন্নত রাখতে প্রয়াত সিভিল সার্জন ডাঃ সাজ্জাদ হোসেনের অবদানের কথা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।
শোকবইতে সিভিল সার্জন লিখেন, ‘কোভিড-১৯ এ আমরা ফেনী জেলার অনেক গুণীজন চিকিৎসক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী, সমাজকর্মী হারিয়েছি। আমরা হারিয়েছি ফেনী জেলার সিভিল সার্জন জনাব সাজ্জাদ হোসাইনকে। তাদের সকলের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আজকের আয়োজনের জন্য ‘আ ভা স' র প্রতি রইল অবিরাম ভালোবাসা।’
অন্যদিকে অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেনী সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রহমান বিকম বলেন, করোনাকালে আমরা যাদের হারিয়েছি, পরিস্থিতির কারণে আমরা অনেকের জানাযায়ও অংশ নিতে পারিনি। ফেনীর বিভিন্ন অঙ্গনের গুণীজনদের হারিয়েছি যারা তাঁদের স্ব স্ব অঙ্গণে সমুজ্জ্বল ছিলেন। তাঁদের এই শূণ্যতা কখনও পূরণ হবার নয়, ফেনীবাসী তাঁদের আজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
এসময় দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। ফেনীর কীর্তিমান মানুষদের স্মরণে যারা আজকের এই নাগরিক শোক সভা আয়োজন করেছেন তাদেরকে তিনি ধন্যবাদ জানায় ও করোনায় মৃত্যুবরণ করা সকল গুণীজনদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন।
অনুষ্ঠানে আরও অনুভূতি প্রকাশ করেন সোনাগাজী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জহির উদ্দিন মাহমুদ চৌধুরী লিপটন, ফেনী বিএমএ সাধারণ সম্পাদক ডাঃ বিমল চন্দ্র দাশ, ফেনী ডায়াবেটিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব, ফেনী সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ফেনী ডায়াবেটিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শুসেন চন্দ্র শীল, ফেনী পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি আইনুল কবির শামীম, জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি রাজীব খগেশ দত্ত, জেলা আইনজীবি সমিতির সাধারণ সম্পাদক পার্থ পাল, জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সমর কুমার দেবনাথ, জেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক মোতাহার হোসেন চৌধুরী, স্টার লাইন গ্রুপের পরিচালক মাঈন উদ্দিন প্রমুখ।
এসময় ফেনীর প্রয়াত কীর্তিমানদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান তারা। এ ধরনের আয়োজনের জন্য আয়োজকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান তারা।
এছাড়া অনুভূতি প্রকাশ করেন প্রয়াত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরাও।
শোক সভায় ফেনীর প্রয়াত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা আজিজ আহম্মদ চৌধুরীর ছোট ছেলে জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) চৌধুরী আহমেদ রিয়াদ আজিজ রাজিব বলেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে অসংখ্য মানুষ ইতিমধ্যে আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছেন। মৃত্যুর এই মিছিলে ফেনীর অসংখ্য গুণীজনকে আমরা হারিয়েছি, আমরা তাঁদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
এসময় বাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমার বাবা সারা জীবন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে রাজনীতি করেছেন। সততা ও নিষ্ঠার সাথে তিনি মানুষের সেবা করে গেছেন। ফেনী জেলা আওয়ামীলীগ ছাড়াও ফেনীবাসীর কাছে তিনি শ্রদ্ধার মানুষ ছিলেন যার বহিঃপ্রকাশ ওনার জানাযায় মানুষে উপস্থিতিতে প্রতীয়মান হয়েছে। আজ ফেনীর মানুষ আমার বাবাকে স্মরণ করছে সেটি আমাদের কাছে বড় পাওনা।
এসময় এই নাগরিক শোক অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য আভাস ও সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
অনুরণন আবৃত্তি কেন্দ্রের সমন্বয়ক এডভোকেট রাশেদ মাযহারের পরিচালনায় স্মৃতিচারণ করেন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নুরুল হক, শিক্ষাবিদ মরহুম মোঃ ইব্রাহিমের ছেলে তাজউদ্দিন পলাশ, মরহুম এডভোকেট খায়েজ আহম্মদের সহধর্মীনি, মরহুম এডভোকেট মফিজুল ইসলামের ছেলে মাইনুল ইসলাম সৌরভ, গবেষক মরহুম কাজী মোজাম্মেল হকের ছেলে কাজী মঈনুল হক প্রমুখ।
‘নাগরিক শোক’ উপলক্ষ্যে কবি শাবিহ মাহমুদের সম্পাদনায় মৃত্যুবরণকারী মুক্তিযোদ্ধা, জনপ্রতিনিধি, সরকারী কর্মকর্তা, সাংবাদিক, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, চিকিৎসকসহ ২৩ জন ব্যক্তির জীবন ও কর্ম নিয়ে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়।
প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে জড়ো হন বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবি সংগঠন, মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরাসহ সর্বস্তরের জনতা। তাদের শ্রদ্ধায় ফুলে ফুলে ভরে ওঠে প্রতীকি শোক মঞ্চ।