‘আমাদের দেশে ভোজ্যতেলের বিশাল ঘাটতি রয়েছে। দেশের চাহিদা মেটাতে অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ফলে তেলের জন্য সরকারকে প্রতি বছর খরচ করতে হয় অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকা। কেবল ভোজ্যতেল আমদানি করতে যে পরিমাণ টাকা ব্যয় করতে হয়, তা সাশ্রয় করা গেলে দেশে প্রতিবছর পদ্মা সেতুর মত এক একটি করে উন্নয়নের সব স্বপ্ন পূরণ করা যায়।’
দেশে ভোজ্য তেলের উৎপাদন বাড়াতে ও সংকট মেটাতে করণীয় প্রসঙ্গে ‘তেল জাতীয়’ ফসল উৎপাদনের গুরুত্ব কৃষকদের কাছে তুলে ধরতে গিয়ে এসব কথা বলেন জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও পোর্টল্যান্ড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান মজুমদার।
আজ বৃহস্পতিবার (২৪ নভেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ফুলগাজী উপজেলার প্রান্তিক ৮শ অস্বচ্ছল কৃষকদের মাঝে সরিষা আবাদের লক্ষ্যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে রোপনের জন্য বীজ ও আবাদের জন্য সার প্রদান করেন তিনি।
ফুলগাজী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দেশের জ্বালানি এবং তেল খাতে প্রতিষ্ঠিত এ ব্যবসায়ী বলেন, টাকা দিয়ে কিনে এনে আমরা যে ভোজ্যতেল খাচ্ছি বা খেতে বাধ্য হচ্ছি, তা কোনভাবেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এর বেশিরভাগে মারাত্মক ভেজাল রয়েছে, একজন ব্যবসায়ী হিসেবে একথা স্বীকার করতে আমার দ্বিধা নেই। আমরা জেনেশুনে নিজের টাকা কিনে সয়াবিন, পাম অয়েল কত কি দেদারসে খাচ্ছি। কিন্তু হিসেব করলে দেখা যায়, এসব তা খেয়ে শুধু নিজের নয়, দেশের অর্থনীতির ক্ষতি ডেকে আনছি।
কৃষিতে আগামীর সম্ভাবনা ও বর্তমান বৈশি^ক সংকটময় অবস্থার কথা তুলনা করে মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের দেশের মত এমন উর্বরা মাটি পৃথিবীর আর কোথাও পাবেন না, একসময় এ মাটিকে বলা হত ‘সোনা’। আজ তার কি হাল হয়েছে তা আপনারা চোখের সামনেই ঘটছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে পরিবারপ্রতি গড়ে পতিত জমি রয়েছে প্রায় তিন শতক। সমষ্টিগত হিসেব করলে তার সংখ্যা প্রায় ১১ কোটি শতকের কাছাকাছি হবে। দেশের সকল কৃষকরা মিলে যদি সকল অনাবাদি জমিতে কেবল তেলজাতীয় ফসল উৎপাদন শুরু করা যায় তাহলে বছরে ২৫-২৭ হাজার কোটি টাকার তেল আমদানি সাশ্রয় করা সম্ভব হয়ে উঠবে।
বৈশি^ক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির প্রসঙ্গ উত্থাপন করে ইস্টার্ণ ইউরোপিয়ান চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সহ সভাপতি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন-ইন্দোনেশিয়ার রফতানি বন্ধের কারণে সারা বিশ্বে ভোজ্যতেল জোগানে ব্যাপক বিঘ্ন ঘটেছে। ফলে অধিক টাকা ব্যয় করার ইচ্ছা থাকলেও তেল মিলছে না। এ যুদ্ধ যদি আরো দীর্ঘায়িত হয় তাহলে সংকট দিন দিন বাড়তেই। সুতরাং এ পরিস্থিতিতে আমাদের সকলকে বিকল্প পরিকল্পনা নিয়ে এখন থেকেই কাজে নেমে যেতে হবে। আর এক্ষেত্রে কৃষকরাই হতে পারেন আমাদের পরম বন্ধু, অপার সম্ভাবনাময় ‘কৃষি অর্থনীতি’র মূল হাতিয়ার।
আমাদের নিজস্ব খাদ্যাভাসের পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু পরিষদ, চট্টগ্রামের এ নির্বাহী সদস্য বলেন, আমরা কম খাব, কিন্তু ভালো জিনিসটা খাবো। সেটি যদি নিজের জমিতেই ফলাতে পারি তাহলে অন্যের কাছে কেন চাইতে যাব। আমাদের সক্ষমতাকে সামগ্রিক ক্ষেত্রে মনেপ্রাণে কাজে লাগাতে হবে।
সুলতান আহম্মদ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা মিজানুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিতে পুর্নাজাগরণ সৃষ্টি করার কথা বারবার বলছেন। নতুন করে ‘কৃষি অর্থনীতি’র অপার সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলতে বলছেন। দেশে সমুদ্রে ও তলদেশে থাকা বিপুল পরিমাণ সম্পদ ব্যবহারের কথা ভাবা হচ্ছে। বাংলাদেশ ‘ব্লু ইকোনমি’ বা সুনীল অর্থনীতির যুগে প্রবেশ করেছে, এতে আমরা প্রত্যেকেই সমান অংশীদার। তাই প্রতিটি জিনিসকে কাজে লাগান, প্রতি ইঞ্চি মাটির সদ্বব্যবহার করুন। বঙ্গবন্ধুর ‘সুখী ও সমৃদ্ধ’ সোনার বাংলাদেশ নিয়ে ভাবুন।
মিজানুর রহমান বলেন, আমার দেশের এক একর জমিতে যে ফসল হয় জাপানে হয় তার তিনগুণ। কিন্তু আমার দেশের মাটি, পৃথিবীর আর কোথাও মিলবে না। আমরা কেন সেই জমিতে দ্বিগুণ-তিগুণ ফসল ফলাতে পারব না। পৃথিবী এখন আমাদের হাতের নাগালের মধ্যেই রয়েছে।
সরিষা আবাদে কৃষকদের আশ^স্ত করে বাংলাদেশ বাঙ্কার সাপ্লায়ার্স এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বলেন, আপনারা যত্ন নিয়ে চাষ শুরু করুন, সবচেয়ে গুণগত কাঁচামাল তৈরি করুন। বিক্রি ও বাজারজাত করার দায়িত্ব আমাদের ব্যবসায়ীদের। সরিষা প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য যাবতীয় যা মেশিনারিজ লাগবে তারও ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ মাসুদ রানা বলেন, ১৩ খাতে বিশ্বের শীর্ষ দশের মধ্যে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। সবজি ও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। ধান ও আলু উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান যথাক্রমে চতুর্থ ও সপ্তম। অথচ আমাদের কাছের দেশ নেপাল তেল উৎপাদনে বিশে^ প্রথম হলেও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
বক্তব্য রাখছেন মিজানুর রহমান মজুমদার। ছবি: দৈনিক ফেনী
সরিষা আবাদের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে কৃষি কর্মকর্তা বলেন, আমন-আউশের মাঝামাঝি সময়ে খালি পড়ে থাকা জমিতে সরিষা চাষ করা যায়। এতে সহজে দোফসলা জমিকে তিনফসলা জমিতে পরিণত করে তোলা যায়। বীজ বপনের ৭০ থেকে ৮০ দিনে সরিষায় ফলন আসে, ফসল উৎপাদনে খরচও কম হয়। কৃষি বিভাগ সরিষা আবাদে কৃষকদের যেকোন পরামর্শ ও সেবা দিতে সবসময় প্রস্তুত রয়েছে। আজ যে উপকরণ দেওয়া হয়েছে, তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতের দায়িত্ব সবাইকে নিতে হবে।
উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ অফিসার কাজী আবু হেনা মেহেদীর সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য রাখেন ফুলগাজী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল আলিম মজুমদার। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন ছাগলনাইয়ার রাধানগর ইউপি’র সাবেক চেয়ারম্যান গরীব শাহ হোসেন বাদশা চৌধুরী, ছাগলনাইয়া পৌর কাউন্সিলর হাবিবুর রহমানসহ উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের স্থানীয় অস্বচ্ছল কৃষকরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ৮শ কৃষককে ৪ লাখ টাকা সমমূল্যের রাসায়নিক সার ও উন্নত জাতের সরিষা বীজ প্রদান করা হয়েছে। প্রত্যেক কৃষককে জমি অনুযায়ী উপকরণ দেওয়া হয়েছে। মিজানুর রহমান জানান, জমিতে সেচ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য একটি সেচ মেশিনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যাতে সরিষা ক্ষেতে সেচ নিয়ে কোন অসুবিধা না হয়।
সারাদিন ভিড় লেগে ছিল ফুলগাজী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রাঙ্গনে। কৃষকদের পাশাপাশি এসেছিলেন কৃষাণীরাও। ছবি: দৈনিক ফেনী
অনুষ্ঠান চলাকালীন কৃষি অফিস চত্ত্বর জুড়ে ছিল মানুষের ভিড়। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার হাতে রয়েছে কৃষকদের তালিকা। তিনি তালিকা ধরে নাম ধরে ডাকছিলেন, কৃষকরা একে এক এসে নিজের প্রাপ্য বুঝে নিচ্ছিলেন। এ তালিকায় ছিলেন উপজেলার দক্ষিণ আনন্দপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবীব উল্লাহ বাহার। সরিষা আবাদের জন্য তিনি বীজ ও সার নিতে এসেছিলেন অনুষ্ঠানে। মিজানুর রহমানের এ উদ্যোগের প্রশংসা করে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, এমন উদ্যোগ যদি আরও আগে নেওয়া হত তাহলে ফুলগাজীর বিস্তীর্ণ প্রান্তর ফলে-ফসলে বছর জুড়ে ভরে থাকত।
স্থানীয় উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল আলিম মজুমদার বলেন, একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে কৃষি ও কৃষকদের উন্নয়নে মিজানুর রহমানের ভূমিকা অতুলনীয়। সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানরা যদি কৃষির সহায়তায় এগিয়ে আসে তবে দেশে কখনো খাদ্যের ঘাটতি হবে না।
উল্লেখ্য, এর আগে গত সোমবার (২১ নভেম্বর) ছাগলনাইয়ার মহামায়া ইউনিয়নের নয়টি ওয়ার্ডের ৩৫০ জন কৃষককে সহায়তা দেন মিজানুর রহমান। তিনি জানান, সম্ভব হলে দেশের প্রতিটি উপজেলার অস্বচ্ছল কৃষককে সহায়তা করবেন।