ফেনীতে সাম্প্রতিক সময়ের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদে ভাঙচুর ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিতে জন্ম ও মৃত্যু নিববন্ধন কার্যক্রমের লক্ষ্যমাত্রা অর্ধেকে নেমেছে। জেলায় প্রতিমাসে ৩ হাজার ৩৫৯ জনের জন্ম নিবন্ধন ও ১ হাজার ৭৭ জনের মৃত্যু নিবন্ধনের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী দেখা গেছে, বিগত আগস্ট-সেপ্টেম্বরে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন লক্ষ্যমাত্রার ৫০ শতাংশও অর্জিত হয়নি।

জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জুলাই মাসে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনে চট্টগ্রামে বিভাগে প্রথম ও দেশের মধ্যে ১২তম অবস্থান ছিল ফেনীর। সাম্প্রতিক বন্যায় ও সরকার পতনের পর ইউনিয়ন পরিষদের বেশকিছু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবং জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিতে গত দুইমাসে নিববন্ধন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। তবে এ কার্যক্রমে গতিশীলতা বাড়াতে কাজ করছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।

জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে জনপ্রতিনিধি শূণ্য হয়ে পড়ে ফেনী। যার প্রভাব পড়ে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রমে। সরকার থেকে জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দিলেও ভোগান্তি কমেনি মানুষের।
এ বিষয়ে কথা হয় ছাগলনাইয়া ঘোপাল ইউনিয়নের নিজামুল হকের সাথে। গত ৫ আগস্টের আগে জন্ম নিবন্ধন সংশোধন করতে দিয়েছিলেন তিনি। তবে এরপর সরকার পতন, বন্যা শেষে দীর্ঘ ১ মাস পর তা সংশোধন করতে পেরেছেন তিনি। দুর্ভোগের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সংশোধন করতে দিলেও এরপর সেটি নিয়ে আসার মত পরিস্থিতি ছিল না। সবকিছু স্বাভাবিক হলেও ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে বারবার ফেরত আসতে হয়েছে। স্থানীয় চেয়ারম্যান না থাকায় তার স্বাক্ষর নিতে পারিনি।

নিবন্ধনে দুর্ভোগের কথা তুলে ধরে পরশুরামের মির্জানগর ইউনিয়নের আব্দুল কাইয়ুম জানান, ভাগিনার জন্ম নিবন্ধন করতে দিয়েছিলাম। তবে ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান নেই, দায়িত্ব পালনে শুরুর দিকে কেউই না থাকায় অনেক ভোগান্তি হয়েছে। আগস্ট- সেপ্টেম্বর মাসে এসব কাজগুলো একেবারেই স্থবির হয়ে পড়েছিল। তবে সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ জন্মসনদ হাতে পেয়েছি। তবে সার্ভার জটিলতার পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি সাধারণ মানুষকে বেশ ভোগাচ্ছে।

ফেনী পৌরসভার আবরার চৌধুরী বলেন, ৫ আগস্টে পৌরসভাতে অগ্নিসংযোগের পরে এর কার্যক্রমে গতিশীলতা বাড়েনি। প্রশাসক নিয়োগ হলেও সবসময় ওনাকে পাওয়া যায় না। কারণ তাকে অন্যত্রও দায়িত্ব পালন করতে হয়। সবমিলিয়ে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন নিয়ে বেশ জটিলতা তৈরি হয়েছে।

এ বিষয়ে ঘোপাল ইউনিয়ন পরিষদ সচিব মোঃ সাদ্দাম হোসেন মজুমদার জানান, বন্যায় ইউনিয়ন পরিষদের সবকিছু একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। ল্যাপটপ, কম্পিউটারসহ সব সরঞ্জাম, আসবাপত্রসব পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। এর কারণে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে লক্ষ্যমাত্রার ২০ শতাংশ ও পুরণ করতে পারেনি। এখন স্থানীয় এক নেতা একটি ল্যাপটপ উপহার দিয়েছে, সেটি দিয়ে কাজ চলছে। তবে কাজ হচ্ছে অনেক ধীরগতিতে, পাশাপাশি অনেক সংশোধিত জন্ম-মৃত্যু সনদ, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ফাইল পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। যার কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।

তিনি বলেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগের পর স্বাক্ষর জটিলতা কিছুটা কমলেও পরিষদে সরকারিভাবে সহযোগিতা না পাওয়া পর্যন্ত আগের উদ্যোমে কাজ সম্ভব হবে না। কারণ পরিষদে উদ্যোক্তা আছে ৩ জন, তাদের ৩টি কম্পিউটার প্রয়োজন, আমার নিজেরও প্রয়োজন। এগুলো ব্যবস্থা করা সবচেয়ে জরুরি।
ফেনী পৌরসভার ডিজিটাল সেন্টার সূত্রে জানা গেছে, পৌরসভাতে আগে ৪টি কম্পিউটার দিয়ে কাজ করা হত, কিন্তু এখন রয়েছে ১টা। আগে কাজে শৃঙ্খলা থাকলেও এখন উদ্যোক্তাদের বসার মতোও অবস্থা নেই। গত ৫ আগস্ট পৌরসভাতে অগ্নিসংযোগের পর অনেক জন্ম-মৃত্যু সনদ পুড়ে গেছে। কম্পিউটার পুড়ে গেছে, জিনিসপত্র লুটপাট করা হয়েছে। এসবের কারণে কার্যক্রমে স্থবিরতা এসেছিল। তবে এখন কাজের গতিশীলতা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।

সাধারণ মানুষের ভোগান্তি প্রসঙ্গে ডিজিটাল সেন্টারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন বলেন, পৌরসভার কার্যক্রমে ভোগান্তি বেড়েছে সাধারণ মানুষের। অনেকে এসে নিজের সংশোধিত নিবন্ধন খোঁজেন, তবে সেগুলো সব পুড়ে গেছে। যাদের অনলাইনে আপলোড হয়েছে সেগুলো পুনরায় প্রিন্ট দেওয়ার চেষ্টা করছি। নতুনগুলোর কাজ করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন গত দুইমাসে একেবারেই কম ছিল। আগে যেখানে দৈনিক ৫০টি করতে পারতাম, এখন ২০টির মত করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ পরিচালক ও ফেনী পৌরসভার প্রশাসক গোলাম মোহাম্মদ বাতেন জানান, ফেনী জুলাই মাসে ১২ তম ও চট্টগ্রাম বিভাগে ১ম ছিল। এরপর আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলন, পরবর্তীতে বন্যার কারণে আগস্ট মাসে কোন কাজই করা সম্ভব হয়নি। পরে বিভিন্ন জায়গায় জনপ্রতিনিধিদের জায়গায় প্রশাসক নিয়োগের পর আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য কাজ করছি। বিভিন্ন জায়গায় অনেক কিছু নষ্ট হয়েছে। সেগুলো কাটিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে পৌরসভাগুলোতে নিবন্ধন কার্যক্রম আগের চেয়ে কিছুটা এগিয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে ট্যাগ অফিসার নিয়োগ হয়েছে, তারা জন্মনিবন্ধনের কাজ চলমান রেখেছেন। তিনি বলেন, নিবন্ধন কার্যক্রমের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সবাই কাজ করছে ফেনীর পূর্বের অবস্থান ফিরিয়ে আনতে।

আজ ৬ অক্টোবর দিবসটি উপলক্ষ্যে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনে ফেনীর বর্তমান পরিস্থিতি সামাধানে করণীয় শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।


এক বছরে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম এগিয়ে সদর,

পিছিয়ে পরশুরাম
বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে (১ জুলাই ২০২৩-৩০ জুন ২০২৪) জেলায় ৫৯ হাজার ৫৮৯টি নতুন জন্ম নিবন্ধন করা হয়েছে এবং একই অর্থবছরে ৫১ হাজার ২৬৯টি জন্ম নিবন্ধন সংশোধন করা হয়েছে। এরমধ্যে সবথেকে বেশি নিবন্ধন ও সংশোধন হয়েছে সদর উপজেলায় এবং সবথেকে কম নিবন্ধন হয়েছে পরশুরাম উপজেলায়। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার শাখা সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রদত্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত অর্থবছরে ফুলগাজীতে মোট ৮ হাজার ৭৬০টি জন্মনিবন্ধন করা হয়েছে। সংশোধন করা হয়েছে ৩ হাজার ৩৮৭টি। উপজেলায় সর্বমোট ১২ হাজার ৩০ জনের জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে।

দাগনভুঞা উপজেলায় মোট জন্ম নিবন্ধনের সংখ্যা ১০ হাজার ৬৯ জন। সংশোধিত নিবন্ধনের সংখ্যা ৮ হাজার ৮১০। উপজেলায় সর্বমোট ১৭ হাজার ৯৩৮ জনের সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে।

সব থেকে বেশি নিবন্ধন হয়েছে সদর উপজেলায়। এ উপজেলায় মোট জন্ম নিবন্ধনের সংখ্যা ১৬ হাজার ৯০৩ জন। সংশোধিত নিবন্ধনের সংখ্যা ১৫ হাজার ২১৯। উপজেলায় সর্বমোট ৩০ হাজার ২৯৪ জনের সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে।

ছাগলনাইয়া উপজেলায় মোট জন্ম নিবন্ধনের সংখ্যা ৯ হাজার ১৭৪ জন। সংশোধিত নিবন্ধনের সংখ্যা ৬ হাজার ৩৫৯। উপজেলায় সর্বমোট ১২ হাজার ৮৬৮ জনের সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে।

সোনাগাজী উপজেলায় মোট জন্ম নিবন্ধনের সংখ্যা ৯ হাজার ৪২০ জন। সংশোধিত নিবন্ধনের সংখ্যা ১০ হাজার ৬২৪। উপজেলায় সর্বমোট ১৫ হাজার ৪৯৭ জনের সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে।

সব থেকে কম নিবন্ধন হয়েছে পরশুরাম উপজেলায়। এ উপজেলায় মোট জন্ম নিবন্ধনের সংখ্যা ৫ হাজার ২৬৩ জন। সংশোধিত নিবন্ধনের সংখ্যা ৬ হাজার ৮৭০। উপজেলায় সর্বমোট ৮ হাজার ৬০ জনের সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে।

বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জেলায় ৭ হাজার ৩৬৫ জনের মৃত্যু নিবন্ধন করা হয়েছে। এরমধ্যে সদরে জেলায় সর্বোচ্চ ২ হাজার ১৫৩ জনের মৃত্যু নিবন্ধন করা হয়েছে। সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে ২ হাজার ২১জন ব্যাক্তির। সংশোধন করা হয়েছে ১৩টি। ফুলগাজী উপজেলায় মৃত্যু নিবন্ধন করা হয়েছে ৬৭৫ জনের। সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে ৫৯২ জন ব্যাক্তির। সংশোধন করা হয়েছে ১টি। ছাগলনাইয়া উপজেলায় ৮২৪ জনের মৃত্যু নিবন্ধন করা হয়েছে। সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে ৭১৩ জন ব্যাক্তির। সংশোধন করা হয়েছে ১১ টি। দাগনভুঞা উপজেলায় ১ হাজার ৮২০ জনের মৃত্যু নিবন্ধন করা হয়েছে। সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে ১ হাজার ৭০৫ জন ব্যাক্তির। সংশোধন করা হয়েছে ২৫টি। সোনাগাজী উপজেলায় ১ হাজার ২৫০ জনের মৃত্যু নিবন্ধন করা হয়েছে। সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে ১ হাজার ২১৯ জন ব্যাক্তির। সংশোধন করা হয়েছে ১৫টি। পরশুরাম উপজেলায় ৬৪৩ জনের মৃত্যু নিবন্ধন করা হয়েছে। সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে ৬২৮ জন ব্যাক্তির। সংশোধন করা হয়েছে ২টি।