ষাটোর্ধ্ব মানুষদের বলা হয়ে থাকে প্রবীণ। প্রতিবছর ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। যেখানে প্রবীণদের সুরক্ষা, অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধার কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। ফেনীতে প্রবীণদের আর্থিক নিরাপত্তা, বিনোদন, পারিবারিক যত্নসহ নানা বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তাঁরা।

২০২২ সালের জনশুমারি হতে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জেলায় মোট জনসংখ্যা ১৬ লাখ ৪৮ হাজার ৮৫২ জন। ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তির সংখ্যা ১ লাখ ৫৯ হাজার ৫২৮ জন, যা মোট জনসংখ্যার ৯.৬৮ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৮২ হাজার ৫৮৯ জন ও নারীর সংখ্যা ৭৬ হাজার ৯৩৯ জন। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে নারীর চেয়ে পুরুষের সংখ্যা বেশি। এছাড়াও প্রবীণদের মধ্যে পরনির্ভরশীলতার হার রয়েছে উল্লেখযোগ্য। ২০২২ সালের জনশুমারির পরিসংখ্যান মতে, ৬৫ বয়সের উর্ধ্বে প্রবীণদের সংখ্যা ১ লাখ ৫ হাজার ২২৯ জন, তাদের মধ্যে ৬২ হাজার ৩৮৩ জন পরিবারের উপর নির্ভরশীল। এ প্রবীণ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই পরিবার ও সমাজ থেকে অবহেলা আর উপেক্ষার শিকার হচ্ছেন। এ নিয়ে তাদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে দৈনিক ফেনী। বক্তব্যে উঠে এসেছে তাদের একাকীত্ব, হতাশা ও অবহেলার কথা।

ফেনী পৌর এলাকার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব আব্দুল আজিজ। তিনি বলেন, চাকরি থেকে অবসর হওয়ার পর এখন অলস সময় কাটে। এখন আগের অবস্থাও নেই যে চাকরি করব। বাসায় খুব অলস সময় পার করতে হয়। ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনী যে যার যার মত ব্যস্ত। পরিবারের সাথে সময় কাটানোর মত পরিস্থিতিও নেই।

ফেনী জেলার দাগনভূঞার উপজেলার বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী। বয়স ৭৫ বছর। তিনি জানান, সারাজীবন পরিবারের জন্য কাজ করেছি, কিন্তু এখন আর আমার কথা শোনার কেউ নেই। ছেলেমেয়েরা ব্যস্ত, তারা কেউ সময় পায় না। জীবনের এসময়ে এসে আমরা কেমন যেন অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছি।

দাগনভূঞা মাতুভূঞা ইউনিয়নের মোমারিজপুর গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ মোস্তফা। তিনি বলেন, আমার বয়স ৬৭ পার হয়েছে। প্রতিদিন ঘরের মধ্যে বসে থাকা ছাড়া তেমন কোনো কাজ নেই। এলাকার তরুণরা যেভাবে নিজেদের মতো করে সময় কাটায় আমাদের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। আমাদের বয়সের মানুষদের সময় কাটানোর জন্য সরকার কোনো বিনোদন কেন্দ্রের ব্যবস্থা করলে আমাদের অলস সময়টা পার হত।

রহিমা বেগম নামের আরেক ষাটোর্ধ্ব বয়োবৃদ্ধ বলেন, আমার ছেলেরা ভালো চাকরি করে, তারা খুব ব্যস্ত। আমি এখন বাড়িতে থাকলেও নিজেকে যেন অতিথি মনে হয়। ছোটখাটো অসুস্থতা হলে কেউ খোঁজ নেয় না। নিজের চিকিৎসা নিজেকেই করতে হয়। সবসময় একাকী সময় পার করতে হচ্ছে।

জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সমাজসেবা প্রবীণদের নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে। ইতিমধ্যে ঢাকার সদর দপ্তর পরিকল্পনা শাখা প্রবীণদের কল্যাণে প্রকল্প নিয়ে ভাবছে। ইতিমধ্যে ঢাকাতে প্রবীণ হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে ও প্রবীণদের কল্যাণে বেশ কয়েক বছর আগে প্রবীণ হিতৈষী সংঘ গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়াও অসহায়-দুঃস্থ ষাটোর্ধ্ব বয়োবৃদ্ধদের জন্য বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রবীণদের নিয়ে আগামীতেও বৃহৎ পরিকল্পনা রয়েছে যেটি নিয়ে সমাজসেবা ও প্রবীণ হিতৈষী সংঘ কাজ করবে।


একমাত্র সংগঠন প্রবীণ কল্যাণ সমিতি
ফেনীতে প্রবীণদের কল্যাণে গড়ে তোলা হয়েছে প্রবীণ কল্যাণ সমিতি। এটি প্রবীণদের নিয়ে জেলার একমাত্র সংগঠন হলেও এর কার্যক্রম দাগনভূঞাতেই উল্লেখযোগ্য। সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, ২০০২ সাল থেকে প্রবীণদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটি। এর মোট সদস্য সংখ্যা শতাধিক হলেও জীবিত রয়েছেন ৭০ জনের বেশি সদস্য। সংগঠনটির সভাপতি হিসেবে মাহমুদুল হক ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হালিম দায়িত্ব পালন করছেন।

এ ব্যাপারে সংগঠনটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন বলেন, প্রবীণ কল্যাণ সমিতি প্রবীণদের কল্যাণের জন্য কাজ করে। তাদের কেউ অসুস্থ হলে খোঁজ খবর নেওয়া হয়। এছাড়া প্রত্যেক মাসের প্রথম শনিবার সভার আয়োজন করা হয়। সংগঠনের কোন সদস্য মারা গেলে তাঁর জন্য দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। রমজান মাসে হাসপাতালে রোগীদের জন্য ইফতারের ব্যবস্থা ও গরিব শিক্ষার্থীদের সাহায্য সহায়তা করা হয়।

সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে সংগঠনটি। আজ দিবসটি উপলক্ষ্যে সকাল সাড়ে ১০টায় দাগনভূঞায় র‌্যালির আয়োজন করা হয়েছে। র‌্যালি শেষে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মিলনায়তনে আলোচনা সভা হওয়ার কথা রয়েছে।


ভাতা পেতেন ৪৯ হাজার প্রবীণ
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের তথ্যমতে, ফেনীতে মোট ৪৮ হাজার ৮৪৮ জন ব্যক্তি মাসিক ৬০০ টাকা করে বয়স্ক ভাতা পেতেন। তবে ভাতাভোগী নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। প্রবীণদের কেউ অভিযোগ বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যাদের সুসম্পর্ক ছিল তারাই মূলত ভাতা পেয়ে এসেছেন।

সমাজসেবা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে যারা আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল অথবা পরিবারে আয়ের উৎস না থাকলে তাদের ভাতার জন্য যোগ্য বিবেচনা করা হত। সেক্ষেত্রে পুরুষদের বয়স ৬৫ বছর এবং মহিলাদের বয়স ৬২ বছরের বেশি হতে হবে।

ফেনী সদর উপজেলার মোটবী ইউনিয়নের ষাটোর্ধ্ব হারুন খান অভিযোগ করে বলেন, পরিবারে কোনো আয়ের উৎস নেই। নিজেও কিছু করার ক্ষমতা নেই। আমার বয়সের অন্যরা বয়স্ক ভাতা পান, কিন্তু তাদের পরিবারের আয়ের উৎস আছে। আমার আয় রোজগার করার মতো কেউ নেই, এরপরও আমি বয়স্ক ভাতা পাইনি।

এ প্রসঙ্গে আব্দুর রাজ্জাক নামের ৬৩ বছরের আরেক বয়োবৃদ্ধ বলেন, ভাতা দেওয়ার ক্ষেতে স্বজনপ্রীতি করা হত। যারা প্রাপ্য তাদের দেওয়া হয় না।

এ প্রসঙ্গে জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সাধারণত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বয়স্ক ভাতার জন্য তালিকা তৈরি করে থাকেন। এক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ বিভিন্ন সময় পাওয়া গেছে। তবে এরকম কেউ যদি ভাতা থেকে বঞ্চিত হয় অনলাইনে আবেদনের বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর নিজেই আবেদন করতে পারেন। তিনি আরও বলেন, সমাজসেবা কার্যালয় উপকারভোগীদের তথ্য হালনাগাদ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠায়। ব্যাংক সরাসরি ভাতা উপকারভোগীদের মোবাইল ব্যাংকিয়ের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়।

জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আরও জানান, মন্ত্রণালয় থেকে সমাজসেবায় নিবন্ধিত প্রবীণ হিতৈষী সংঘের জন্য কিছু অনুদানের ব্যবস্থা আছে, তবে সেটি জেলাভিত্তিক নয়। এই সংস্থা মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি অনুদান পেয়ে থাকে। আমরা সরাসরি প্রবীণদের জন্য বরাদ্দ পাইনা। তবে সরকার সমাজসেবার মাধ্যমে প্রবীণদের জন্য বয়স্ক ভাতা প্রদান করে থাকে।


শতায়ুতে ফেনীর ৩৬০ জন
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, এখন দেশে মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৩ বছর। শতায়ু বেঁচে থাকার সৌভাগ্য খুব একটা বেশি মানুষের হয় না। ২০২২ সালে জনশুমারি হতে দেখা গেছে, ফেনীতে শতায়ু এবং তদোর্ধ্ব বয়সী মানুষ রয়েছেন ৩৬০ জন। এদের মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। জনশুমারি অনুযায়ী, ফেনীতে শতায়ু লাভ করা পুরুষের সংখ্যা ১৩৩ জন, যা মোট সংখ্যার ৩৬.৯৪ শতাংশ এবং নারীর সংখ্যা ২২৭ জন, যা মোট সংখ্যার ৬৩.০৬ শতাংশ।