বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়া এমন এক নাম, যাকে কেবল ক্ষমতায় থাকার সময়ের হিসাব দিয়ে বিচার করা অসম্ভব। কারণ তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ, সবচেয়ে কঠিন এবং সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়টি রচিত হয়েছে ক্ষমতার বাইরে। এই অধ্যায়টি কোনো বিজয় মিছিলের নয়, বরং ধৈর্য, দৃঢ়তা, নীরব সহ্য এবং আপসহীন অবস্থানের এক দীর্ঘ ইতিহাস।
খালেদা জিয়া শাসক ছিলেন—দু’বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তাঁর শাসনামলে সাফল্য ছিল, ব্যর্থতাও ছিল। রাষ্ট্র পরিচালনায় ভুল ছিল, বিতর্ক ছিল, সমালোচনা ছিল। ৪৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনে কেউই এসবের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন না। কিন্তু রাজনীতির ইতিহাস শেষ পর্যন্ত শুধু ক্ষমতার সাফল্যুব্যর্থতার হিসাব দিয়ে লেখা হয় না। অনেক সময় ইতিহাস নির্ধারিত হয় সেই মানুষদের দ্বারা, যাঁরা ক্ষমতা হারিয়েও ভেঙে পড়েন না, যাঁরা দীর্ঘ নিপীড়নের মধ্যেও নিজের জায়গা ছাড়েন না। খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে।
নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি আপসহীন অবস্থানে ছিলেন। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক চরিত্রের প্রকৃত দৃঢ়তা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা যায় ২০০৭ুপরবর্তী সময় এবং বিশেষ করে গত ১৬/১৭ বছরে। এটি ছিল এমন এক সময়, যখন একটি সর্বময় কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি একের পর এক ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক ও শারীরিক আঘাত সহ্য করেছেন। মামলা, কারাবাস, অসুস্থতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা—সব মিলিয়ে তাঁর জীবনকে এক ধরনের মানবেতর বাস্তবতার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।
এই পরিস্থিতিতে অনেক রাজনৈতিক নেতা ভিন্ন পথ বেছে নেন। কেউ আপস করেন, কেউ নিজেকে গুটিয়ে নেন, কেউ ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার চেষ্টা করেন। খালেদা জিয়ার সামনেও সেই দরজাগুলো খোলা ছিল। চাইলে তিনি সমঝোতার রাজনীতি করতে পারতেন। চাইলে ব্যক্তিগত জীবনকে তুলনামূলক নিরাপদ ও আরামদায়ক করে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।
এই নাুকরাটাই তাঁর রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।
এই সিদ্ধান্ত কেবল ব্যক্তিগত দৃঢ়তার পরিচয় নয়, এটি ছিল একটি রাজনৈতিক ধারাকে বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত। কারণ বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রকাঠামোয় একটি বড় রাজনৈতিক দল যদি দীর্ঘ সময় ধরে আপসকামী অবস্থান নেয়, তাহলে সেটি ধীরে ধীরে নিজস্ব চরিত্র হারিয়ে ফেলে। বিএনপির টিকে থাকা—টানা নিপীড়ন, মামলা, গুম, হামলা, গ্রেপ্তার, নির্বাচনী ব্যবস্থার ভাঙনের মধ্যেও—একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। এটি কোনো গুপ্ত বা সশস্ত্র দল নয়, বরং একটি প্রকাশ্য গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। এই টিকে থাকাটা অনেকাংশেই সম্ভব হয়েছে একজন খালেদা জিয়ার কারণে।
খালেদা জিয়া কখনো দল ছাড়েননি। কখনো নেতাকর্মীদের পরিত্যাগ করেননি। তিনি নিজেকে সরিয়ে নিয়ে দলকে বাঁচানোর কৌশল নেননি, বরং নিজেকে সামনে রেখেই সব আঘাত সহ্য করেছেন। এই আত্মউৎসর্গ ছিল নীরব, কিন্তু গভীর। এখানে ‘আইরন লেডি’ অভিধা দিয়ে তাঁকে বোঝানো যায় না। তিনি উচ্চকণ্ঠ ছিলেন না, আগ্রাসী ছিলেন না। তাঁর রাজনীতি শেষদিকে হয়ে উঠেছিল স্থির, সংযত এবং ধৈর্যনির্ভর।
এই ধৈর্য ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি। এটি নিষ্ক্রিয় ধৈর্য নয়—বরং সচেতন ধৈর্য। তিনি জানতেন, প্রতিটি অন্যায়ের তাৎক্ষণিক জবাব দেওয়া সম্ভব নয়। তিনি সময়ের ওপর আস্থা রেখেছিলেন। নিগৃহীত হয়েও তিনি প্রতিশোধের ভাষা ব্যবহার করেননি। আগস্টুপরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতায়ও তিনি প্রতিহিংসার কথা বলেননি। উপমহাদেশের রাজনীতিতে, যেখানে প্রতিশোধ প্রায় নৈতিকতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, সেখানে এই সংযম ছিল ব্যতিক্রমী এবং গভীরভাবে রাজনৈতিক।
খালেদা জিয়ার রাজনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে বয়স্ক নারীুপুরুষদের মধ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কোনো প্রচারণা দিয়ে তৈরি হয়নি। এটি এসেছে দীর্ঘদিনের মাঠের রাজনীতি, আন্দোলনের সময় পাশে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে। তিনি ছিলেন দৃশ্যমান—ক্ষমতায় থাকাকালেও, ক্ষমতার বাইরে থাকাকালেও।
আমার কাছে খালেদা জিয়া কোনো বিমূর্ত রাজনৈতিক প্রতীক নন। তিনি স্মৃতির ভেতর থাকা একজন মানুষ। ছোটবেলায় মহিপালের এক পথসভায়, নানার বাড়ির কোনো এক মামা বা ভাইয়ের কাঁধে উঠে প্রথম তাঁকে দেখেছিলাম। অসংখ্য মানুষের ভিড়ের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা এক নারী—মুখাবয়ব স্পষ্ট মনে নেই, কিন্তু উপস্থিতির ভার আজও মনে আছে। অনেক বছর পর, ২০১১ সালের রোড মার্চে আবার তাঁকে দেখি। তখন আমি চট্টগ্রাম চারুকলায় পড়ি। সেই রোড মার্চের সাজসজ্জা, ভিজ্যুয়াল পরিকল্পনা, প্রচারণার নানা কাজে যুক্ত ছিলাম। সেটাই ছিল শেষ দেখা।
এরপর আর তাঁকে সামনে থেকে দেখা হয়নি। কেবল দূর থেকে দেখা হয়েছে তাঁর ওপর নেমে আসা একের পর এক অন্যায়, অবিচার আর নীরব সংগ্রাম। আমরা অনেকেই সাক্ষী ছিলাম। আমাদেরও ক্ষরণ হয়েছে—কারণ আমরা খুব বেশি কিছু করতে পারিনি। তবু সময় থেমে থাকেনি। সময় নিজের মতো করে বিচার করেছে। অনেক সত্য আজ প্রকাশিত, অনেক হিসাব আজ মিলছে। শুধু এটুকু বুঝিনি—তিনি পুরোটা দেখে যেতে পারেননি।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সংগ্রাম আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়—ক্ষমতা কখনো কখনো মানুষকে বড় করে না, বরং ক্ষমতার বাইরে থাকার সময়টাই মানুষকে ইতিহাসে স্থায়ী করে। ক্ষমতা মানুষকে শেইপ করতে পারে, আবার গুঁড়িয়ে দিতেও পারে। কিন্তু ক্ষমতার বাইরে দাঁড়িয়ে ভেঙে না পড়া, নিজেকে বিসর্জন না দেওয়া—এই গুণটি বিরল।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়া সেই বিরলতার প্রতিনিধি। তিনি নিখুঁত ছিলেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন দৃঢ়। তিনি সব সময় সঠিক ছিলেন না, কিন্তু তিনি কখনো আত্মসমর্পণ করেননি। এই কারণেই তাঁর রাজনৈতিক জীবন কেবল একটি দলের ইতিহাস নয়, এটি এই রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
এই অধ্যায় হয়তো অনেক বিতর্কের জন্ম দেবে, সমালোচনা হবে, মূল্যায়ন বদলাবে। কিন্তু এটুকু অস্বীকার করা কঠিন—বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার রাজনীতিকে বাংলাদেশে একটি নৈতিক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
বিদায় জানাতে হয় একজন মানুষকে, কিন্তু থেকে যায় তাঁর রেখে যাওয়া সংগ্রাম।
লেখক: চিত্রশিল্পী ও সংগঠক
