“জীবনের প্রকৃত অর্থ তো তখনই খুঁজে পাওয়া যায়, যখন মানুষ নিজের সীমিত সময়কে অন্যের কল্যাণে ব্যয় করে।” এই কথার বাস্তব প্রতিচ্ছবি ছিলেন কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার আলগাপাড়া গ্রামের মো. মনু মিয়া।
তিনি ছিলেন এমন এক নীরব যোদ্ধা, যিনি জীবনের প্রতিটি দিন ব্যয় করেছেন পরের মৃত্যুর জন্য। তবে শোক নয়, তার ভূমিকা ছিল প্রস্তুতি আর প্রার্থনায়। ২৮ জুন, ২০২৫ শনিবার সকাল ১০টায় নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহান মানুষটি। তার মৃত্যুসংবাদ একে একে ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, জাতীয় দৈনিক, অনলাইন নিউজপোর্টালসহ সর্বত্র। তবে তিনি প্রচারের জন্য ছিলেন না তিনি ছিলেন বেঁচে থাকার পরিপূর্ণ মানে হয়ে ওঠার এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
তিনি ছিলেন একজন কৃষক। তবে মাঠের চাষির চেয়েও বেশি, তিনি হয়ে উঠেছিলেন মৃত্যুর শেষ প্রস্তুতির শ্রমিক। কোনো মানুষ মারা গেলে তিনি দেরি করতেন না এক মুহূর্তও। নিজের প্রিয় বাহন, একটি ঘোড়া, আর হাতে কোদাল নিয়ে ছুটে যেতেন ওই বাড়িতে যেখানে কান্নার শব্দ জানান দিত কারো চলে যাওয়ার। তিনি জানতেন, এখন সময় কারো ‘শেষ ঘর’টি প্রস্তুত করার।
“আমার কাজ নয়, এটা আমার ইবাদত” এই এক বাক্যে তিনি বুঝিয়ে দিতেন নিজের জীবনের দর্শন। পারিশ্রমিকের প্রস্তাব পেলেই ফিরিয়ে দিতেন। বলতেন, “মৃত মানুষের দায়িত্ব পালন করছি, এটা আল্লাহর কাছে জমা রাখছি।”
তাঁর কোদাল থেমে থাকেনি কখনো। জীবনের প্রায় তিন দশক ধরে তিনি খুঁড়েছেন তিন হাজারেরও বেশি কবর। সংখ্যাটি কেবল পরিসংখ্যান নয় এই সংখ্যার প্রতিটি কবরে শুয়ে আছেন কোনো সন্তানের জননী, কোনো বাবার প্রিয় সন্তান, কিংবা কোনো নিঃসঙ্গ প্রৌঢ়, যার জন্য অপেক্ষা করছিল অনন্তের শান্তি। মনু মিয়া সেই শান্তির দরজা খুলে দিতেন হাতে কোদাল ধরে, নীরবে। তিনি ছিলেন না পেশাদার গোরখোদক, ছিলেন না কোনো স্থানীয় পরিষদের নিয়োজিত ব্যক্তি। ছিলেন একজন দায়িত্ববান আত্মা, যার প্রতিটি কাজ মানবতার নিঃশব্দ জয়গান হয়ে ওঠে।
জাতীয় দৈনিকগুলোর বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, মনু মিয়ার মতো মানুষেরা সমাজের সীমানার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করেন ভিতরের জন্য। তারা কেউ রাষ্ট্রীয় বেতনভুক্ত নন, তবুও সবচেয়ে বড় দায়টা তারা নিজেরাই কাঁধে তুলে নেন। এমন একজন মানুষের গল্প কি পাঠ্যপুস্তকে স্থান পাওয়ার যোগ্য নয়? গণমাধ্যমে এমন প্রশ্ন এসেছে বারবার। কারণ, একজন নিঃস্বার্থ কবর প্রস্তুতকারী শুধুই একজন শ্রমিক নন, তিনি আমাদের ভুলে যাওয়া দায়বোধের প্রতিচ্ছবি। তার প্রতিটি কোদালের ঘা যেন প্রশ্ন ছুড়ে দেয় আমরা কবে মানুষের জন্য এমন কিছু করতে শিখব?
এই মৃত্যু কেবল একজন নির্লিপ্ত কর্মীর না ফেরার যাত্রা নয়, এটি আমাদের মনুষ্যত্বের এক স্তম্ভচ্যুতি। শহরে বসে আমরা হয়তো ভাবতেই পারি না মৃত্যুর পরে শেষ আশ্রয় তৈরিতে কতটা নিঃশব্দ শ্রম জড়িত। সেই শ্রম আজ থেমে গেছে। এখন ঘোড়ার খুরের শব্দ আর শোনা যাবে না; কোদালের ভার আর বহন করবে না মনু মিয়ার হাত। আজ তিনি নিজেই চিরঘুমে শুয়ে আছেন সেই ঘরে, যেরকম ঘর তিনি আজীবন অন্যের জন্য প্রস্তুত করেছেন। আমরা দোয়া করিÑআল্লাহ যেন তাঁকে শান্তি ও সম্মানের এমন ঠিকানায় স্থান দেন, যেখানে কান্না নেই, ক্লান্তি নেই, কেবল প্রশান্তি।
আমিন।