বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস ছিল উত্তাল ঘটনাবহুল মাস। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ হঠাৎ এক হটকারী সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার আপামর জনতা। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর ২৫ মার্চ পর্যন্ত নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন রূপ নেয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রতিদিনের ঘটনাপ্রবাহ থাকছে দৈনিক ফেনীর পাঠকদের জন্য। আজ ২২ মার্চের ঘটনা প্রবাহ:
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সকালে ২৫ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেন, তাতে বলা হয়, পাকিস্তানের উভয় অংশের নেতৃবৃন্দের মধ্যে আলোচনাক্রমে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের পরিবেশ সম্প্রসারণের সুযোগ সৃষ্টির জন্য ২৫ মার্চের অধিবেশন স্থগিত রাখা হয়েছে।
সকালে রমনার প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, শেখ মুজিবুর রহমান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক প্রায় ১ ঘন্টা ১৫ মিনিট স্থায়ী হয়।
প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে নিজ বাসভবনে ফিরে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আন্দোলনে আছি এবং লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
এদিন প্রেসিডেন্ট মিয়া মমতাজ দৌলতানা, সরদার শকত হায়াত খান, মওলানা মুফতি, খান আব্দুল ওয়ালী খান ও মীর গাউস বক্সের সাথেও আলোচনায় মিলিত হন।
প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে কড়া সামরিক প্রহরায় হোটেলে ফিরে দুপুরে ভুট্টো তার উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন।
ভুট্টোর নেতৃত্বে পিপলস পার্টি নেতৃবৃন্দ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে যান এবং প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের সাথে আলোচনায় মিলিত হন।
রাতে ভুট্টো হোটেল লাউঞ্জে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, প্রেসিডেন্ট এবং আওয়ামী লীগ প্রধান বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের জন্য একটি সাধারণ ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। তবে ঐ ঐকমত্যের ভিত্তিতে যদি জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের আগেই সামরিক আইন প্রত্যাহার ও ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয় তবে তা কখনই পিপলস পার্টির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না এবং ঘোষণাটি ‘আইনগত বৈধতাহীন’ হয়ে পড়বে। পিপলস পার্টির অনুমোদন ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত পশ্চিম পাকিস্তানিরা মেনে নিতে পারে না।
এদিকে এদিন আইন বিশেষজ্ঞ এ কে ব্রোহি বলেন, ‘ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে আইনগত কোন বাধা নেই’।
অসহযোগ আন্দোলনের একবিংশ দিনে জয় বাংলা শ্লোগানে মুখরিত হাজার হাজার মানুষ শেখ মুজিবের বাসভবনের দিকে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যায়। বাসভবনে সমবেত জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বেশ কয়েকবার বক্তৃতা দেন। সংগ্রামী জনতার গগণবিদারী ‘জয় বাংলা’ ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব’ শ্লোগানের মধ্যে জনগণের নেতা ঘোষণা করেন, ‘বন্দুক, কামান, মেশিনগান কিছুই জনগণের স্বাধীনতা রুখতে পারবে না’।
১৯৭১ সালের এই দিনে বায়তুল মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণে শিশু-কিশোরদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ শেষে শিশু-কিশোররা বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে। পল্টন ময়দানে সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক বাঙালি সৈনিকরা এ সমাবেশ ও কুচকাওয়াজের আয়োজন করে। সমাবেশে বক্তারা বলেন, বাংলার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে অভূতপূর্ব ঐক্য গড়ে উঠেছে তাতে সাবেক সৈনিকরা আর সাবেক হিসেবে বসে থাকতে পারে না। আমাদের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মূল্যবান সম্পদ। আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পালনে প্রস্তুত। সমাবেশ শেষে এক কুচকাওয়াজের অনুষ্ঠিত হয়। প্রাক্তন বাঙালী সৈনিকরা মেজর জেনারেল এম আই মজিদের সভাপতিত্বে সমাবেশে কর্নেল ওসমানী, ফ্লাইট লেফটেনেন্ট খলিলুল্লাহ, কমোডর জয়নুল আবেদিন, আশ্রাফ মাহমুদুন্নবী, সৈয়দ আহমদ প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন।
পত্রিকায় পাঠানো এক বিশেষ বাণীতে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমাদের আন্দোলনের বৈধতার কারণে বিজয় এখন থেকে আমাদেরই। বাংলাদেশের সব দৈনিক পত্রিকার জন্য পাঠানো এ বাণীটির শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশের মুক্তি।’ বাণীতে সাত কোটি বাঙালির সামগ্রিক মুক্তির জন্য চলমান আন্দোলনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু বলেন, চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এ সংগ্রাম চলবে। বুলেট, বেয়োনেট ও বন্দুক দ্বারা বাংলাদেশের মানুষকে স্তব্ধ করা যাবে না, কারণ তারা আজ ঐক্যবদ্ধ। আমাদের লক্ষ্য অর্জনে যে কোনো প্রকার আত্মত্যাগে আমরা প্রস্তুত। যে কোনো আক্রমণ প্রতিহত করতে বাংলাদেশের প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রাতে ২৩ মার্চ ‘পাকিস্তান দিবস’ উপলক্ষে প্রদত্ত এক বাণীতে বলেন, ‘নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মিলে-মিশে একসঙ্গে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তান এখন এক ক্রান্তিলগ্নে উপনীত। গণতন্ত্র প্রত্যাবর্তনের পথে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে। তবে আমরা যদি আমাদের লক্ষ্যে অবিচল থাকি তাহলে কোনো কিছুই আমরা হারাবো না’।
এদিন সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতায় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রচারিত বাংলাদেশের পতাকার প্রতিকৃতি প্রকাশিত হয় এবং ২৩ মার্চ এই পতাকা উত্তোলন ও পাকিস্তানের পতাকা বর্জনের আহ্বান জানান হয়।
চট্টগ্রামে পতাকার প্রচার ও তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে ছাত্র ইউনিয়ন পতাকা বিক্রি করে। এসময় চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি ওয়ালিউল ইসলাম পাঁচলাইশে মেজর জিয়াউর রহমানের বাসায় গিয়ে তার কাছে একটি পতাকা বিক্রি করে।
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের কর্মচারীরা দ্বিতীয় দিনের মতো বুকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ও কালো ব্যাজ ধারণ করে ভুট্টো ও তার সাথীদের সেবা প্রদান করেন।
লেখক সংগ্রাম শিবির বাংলা একাডেমীতে ড. আহমদ শরীফের সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদী কবিতা পাঠের আসর আয়োজন করে। এতে আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ফজল শাহাবুদ্দিন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হুমায়ুন কবির, শাহনুর খান, আখতার হোসেন, রফিক নওশাদ, মাহবুব সাদিক, সালেহ আহম্মদ, দাউদ হায়দার, মাকিদ হায়দার, মেহেরুন্নেসা প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।