একসময় চিঠিই ছিল আবেগ প্রকাশের ভাষা, সংবাদ পাঠানোর মাধ্যম ও যোগাযোগের অন্যতম ভরসা। ডাকপিয়নের বাঁশির শব্দে চেনা যেত সুখ-দুঃখের খবর। কিন্তু প্রযুক্তির অগ্রগতিতে এখন সেই চিঠির দিন যেন শেষ হয়ে গেছে। তবুও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডিজিটাল সেবা চালু করে নতুন করে টিকে থাকার চেষ্টা করেছে ডাক বিভাগ।

আজ বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) বিশ্ব ডাক দিবস। জেলার অধিকাংশ ডাকবাক্সগুলো এখন বার্ধক্যের ছাপ নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে কেবলই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। এখন সরকারি চিঠিপত্র, সঞ্চয়পত্র সেবা ও ডিজিটাল সেবার ভীড়ে অচল হয়ে কোনরকম টিকে আছে ডাকঘরগুলো। ফেনীর জেলা-উপজেলায় অবস্থিত ডাকঘরগুলোর চিত্র প্রায় একইরকম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার প্রধান ডাকঘরের অধীনে ছয় উপজেলায় ৬টিসহ ইউনিয়ন পর্যায়ে মোট ৫৩টি শাখা ডাকঘর ও উপ-ডাকঘর রয়েছে। জেলা-উপজেলা ডাকঘর ব্যতীত অধিকাংশ কার্যত ঝিমিয়ে চলছে।

ফেনী সদর ডাকঘরের পোস্টম্যান মো. শওকত আলী বলেন, আগে দিনে শতাধিক চিঠি আদান-প্রদান হতো। এখন সপ্তাহে হাতেগোনা কয়েকটি চিঠিই আসে। বেশিরভাগই দাপ্তরিক চিঠি। মানুষ এখন ফোন, ই-মেইল বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবর দেয়। ফলে ডাকঘরের সেই কোলাহল এখন অতীত। এক সময় মানি অর্ডার, পোস্টকার্ড ও শুভেচ্ছা কার্ড ছিল ডাক বিভাগের নিয়মিত কাজ। এখন চিঠির জায়গা দখলে নিয়েছে দাপ্তরিক পত্র, আদালতের নোটিশ ও সরকারি নথি। আগে গ্রামে গেলে মানুষ জড়ো হয়ে যেত ডাকটিকিটে কার চিঠি আসছে দেখার জন্য, এখন আমাদের নির্দিষ্ট বিট ভাগ করা থাকলেও গ্রামেগঞ্জে যাওয়া লাগে না।

ফেনী জেলা ডাক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জেলায় বর্তমানে ডাক বিভাগের ৫৩টি শাখা ডাকঘর রয়েছে। সরকারি দপ্তরের চিঠি নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। তবে পার্সেল, ইএমএস ও অনলাইন মানি অর্ডার এখন ডাক বিভাগের মূল সেবা হিসেবে টিকে আছে। প্রতিদিন জেলায় ইএমএস পার্সেল পরিবহন করা হয়। এছাড়া প্রতিদিন অনলাইন মানি অর্ডার দেওয়া-নেওয়া হয়। ডাকঘরে ইতোমধ্যে চালু হয়েছে 'ডিজিটাল পোস্ট অফিস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম', যেখানে সব তথ্য অনলাইনে সংরক্ষিত থাকে। একজন গ্রাহক কুরিয়ার করলে অনলাইনেই সেটি ট্রেকিংয়ের মাধ্যমে দেখতে পারেন।

এদিকে ফেনী শহর ও উপজেলা সদরগুলোতে এখন প্রায় ২০টির মতো বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিস কাজ করছে। অনেকে দ্রুত সেবা ও অনলাইন ট্র্যাকিং সুবিধার কারণে কুরিয়ারের দিকে ঝুঁকছেন। ডাক বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্যান্য কুরিয়ারের আধুনিক সেবার ভীড়ে সরকারি ডাক বিভাগ এখন নির্ভরযোগ্য সেবা হিসেবে সরকারি কাগজপত্র, আদালতের চিঠি ও ব্যাংক সংক্রান্ত পার্সেল পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে পুরাতন দিনের যে ডাকের কদর নিয়ে আক্ষেপ জানিয়েছেন অনেকে।

ফেনী জেলা ডাক বিভাগের পোস্ট অপারেটর শাখাওয়াত হোসেন রাজিব বলেন, চিঠির দিন শেষ, কিন্তু ডাক বিভাগের কাজ শেষ হয়নি। এখন ডিজিটাল সেবার যুগ। মানুষ ঘরে বসেই ডাক বিভাগের অ্যাপ থেকে পার্সেল পাঠাতে পারছে, মানি অর্ডার দিতে পারছে, এমনকি ট্র্যাকও করতে পারছে। এতে আবার আস্থা ফিরছে।

ফেনী প্রধান ডাকঘরের পোস্টমাস্টার মো. কামাল হোসেন বলেন, বর্তমানে আমাদের পোস্ট অফিসে সরকারি চিঠিপত্র, পার্সেল, মানিঅর্ডার, ইলেকট্রনিক মানি ট্রান্সফার, পোস্টাল ক্যাশ কার্ড, ডাক জীবন বীমা, সঞ্চয় ব্যাংক, পোস্টেজ ও রাজস্ব স্ট্যাম্প বিক্রিসহ বহুমুখী সেবা প্রদান করা হচ্ছে। ব্যক্তিগত চিঠি কমলেও দাপ্তরিক চিঠির পাশাপাশি আধুনিক অনেক সেবা প্রদান করা হচ্ছে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন পরীক্ষার খাতা ডাকবিভাগে আসে। অনেক রেমিট্যান্স যোদ্ধা দেশের বাইরে থেকে অনেক পণ্য পাঠায়। স্বল্প টাকায় নিরাপদভাবে পণ্য আনা নেওয়া করা সম্ভব হয়। কুরিয়ার সার্ভিসের ক্ষেত্রেও ডাক বিভাগ পিছিয়ে নেই, ডিজিটাল পদ্ধতিতে সব কাজ পরিচালিত হচ্ছে। যদি আধুনিকতার ছোঁয়া গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া যায় এবং ডাকঘরগুলোকে আরও সচল করলে সেবার মান বাড়বে।

মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী নামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, এ প্রজন্ম চিঠি কি, ডাকবাক্স কি, তা চেনেই না। অথচ আমাদের ছাত্র ও চাকরিজীবনে কত চিঠি লিখেছি। যোগাযোগ, গুরুত্বপূর্ণ নথি ও টাকা আদান-প্রদানের একমাত্র মাধ্যম ছিল পোস্ট অফিস। তখনকার অনুভূতি এখনকার প্রজন্ম বুঝবে না। এখন তো চিঠি কেউ লিখেনা, সবাই প্রযুক্তিনির্ভর।

মশিউর রহমান নামে এক স্কুল শিক্ষক বলেন, মানুষের হাতে মোবাইল ইন্টারনেট আসার পর চিঠির কদর কমে গেছে। চিঠি পাঠানো এখন কম হলেও সরকারি নথি, পরীক্ষার রেজাল্ট, অফিসিয়াল পার্সেল সবকিছু দ্রুত পৌঁছাচ্ছে। ডাকঘরের ডিজিটাল সেবা না থাকলে আমরা হয়তো অনেক সময় নষ্ট করতাম। ডিজিটাল সেবা চালু হওয়ার পর ডাকঘর ব্যবহার অনেক সময় সাশ্রয়ী হয়েছে। মানি অর্ডার পাঠানো বা পার্সেল ট্র্যাক করার বিষয় যুক্ত হওয়াতে প্রযুক্তিগতভাবে ডাকবিভাগ গ্রহণযোগ্য হচ্ছে সবার কাছে।

নোয়াখালী-ফেনী ও লক্ষীপুরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি পোস্ট মাস্টার জেনারেল শংকর কুমার চক্রবর্তী বলেন, আগে সঞ্চয়পত্রগুলো লাইনে দাঁড়িয়ে দিতে হতো এখন মোবাইল এন্সের মাধ্যমে দেওয়া যাচ্ছে, এতে মানুষের ভোগান্তি কমেছে কয়েকগুণ। পাশাপাশি একটি পণ্য কি অবস্থায় আছে সেটি ঘরে বসে ট্র্যাকিংয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ডিজিটাল পদ্ধতি আসাতে সার্ভারে তথ্য সংরক্ষিত থাকে, হারানোর কোন ভয় থাকে না। এসব ডাক বিভাগের আধুনিক সেবা যা গ্রাহক পাচ্ছে। তিনি বলেন, এখন ব্যক্তিগত চিঠি কমলেও ব্যবসায়িক চিঠি কিংবা পণ্য আদান প্রদান বেড়েছে, যার কারণে প্রতিদিন নতুন নতুন কুরিয়ার ব্যবসা আসছে। ডাক বিভাগ ডিজিটাল সেবায়ও অবদান রাখছে এবং এর পাশাপাশি গ্রাম কেন্দ্রিক যেসকল উপ ডাকঘর গুলো রয়েছে সেগুলোও আধুনিকায়ন করার চেষ্টা চলছে, আগামীতে বাস্তবায়ন হবে।