এক.
বাংলাদেশের গত জুলাইয়ের গণ-আন্দোলন অগাস্টে এসে গণ-অভ্যুত্থানের পরিণত হয় । যার পরিণতিতে মাত্র ২০-২৪দিনে ১৬ বছরের নিষ্ঠুরতম ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটে। সরকার প্রধান শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। বাংলাদেশের এ-আন্দোলনে প্রথমে শিক্ষার্থীরা পরে দেশের আপামর মানুষ যুক্ত হয়। এ-সংযুক্তিকরণ বিস্ময়কর। আন্দোলনের অন্যতম এক তাত্ত্বিক ছাত্রনেতা পরবর্তীকালে বলেন, তাঁরা আন্দোলনে নতুন ভাষা ব্যবহার করেছেন : এক মিনিট নীরবতা পালনের প্রোগ্রাম ঘোষণা করলে সাথে বলেছেন কেউ ইচ্ছে করলে দোয়াও পড়তে পারে। মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করলে কেউ চাইলে সেটা না করে দোয়াও করতে পারেন। এ ভাষা অন্তর্ভুক্তিমূলক। এ-থেকে বোঝা যায়, নানান মতপথের মানুষকে তাঁরা যুক্ত করেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে এসে ছাত্ররা শিক্ষকদের, অভিভাবকদের, শ্রমজীবী মানুষদের সংযুক্ত করে। তাঁদের আন্দোলন পরিচালনার কৌশল ছিলো অভিনব। তাঁরা বিভাজনের মাধ্যমে শাসননীতির কৌশল পরিহার করে। বিপরীতে ইনক্লুসিভ (অন্তর্ভুক্তিমূলক) কৌশল গ্রহণ করে। হরতাল, ধর্মঘট অবরোধ জাতীয় প্রথাগত আন্দোলনের কৌশল ওরা ব্যবহার করে নি। বরং তারা শাটডাউন, কমপ্লিট শাট ডাউন, বাংলা ব্লক, জাতীয় শব্দ ব্যবহার করে। আন্দোলনের প্রয়োজনে নিত্যনতুন কৌশল যুক্ত করে। যেমন, ক্রমশ হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা বাড়তে শুরু করলে রিমেমবারিং আওয়ার হিরোজ, দেয়াল লিখন- এসব প্রোগ্রাম দিতে থাকে। মজার বিষয় হলো, এসব ইংরেজি নাম কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে নি দেশব্যাপী যোগাযোগে। এক রিকশাচালককে দেখেছি পতাকা মাথায় বেধে রিকশার সিটে দাঁড়িয়ে দেয়াল লিখনকে সেলিউট দিতে।
এ-আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য, মাত্রা ও গভীরতা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এখনো চূড়ান্ত কিছু বলার সময় আসে নি। তবে সাধারণ চোখে এআন্দোলনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। এ-আন্দোলন ছিলো এক. নির্দলীয় দুই. তারুণ্যের আন্দোলন তিন. আন্দোলনের ভার্চুয়াল বাস্তবতা ছিলো লক্ষণীয় চার. নারীর অংশগ্রহণ বিপুল। একটি সফল গণ-আন্দোলন এভাবে দলহীন তরুণ ছাত্রদের প্রবল প্রতিরোধে, গণমানুষের অংশগ্রহণে গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হওয়া পৃথিবীতে নজিরবিহীন।
দুই.
বাংলাদেশ একটা অদ্ভুত রাষ্ট্র। কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নয়, কেবল গণতান্ত্রিক একটা সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ৫০/৫৫ বছরের মধ্যে তিন তিনটা গণ-অভ্যুত্থান করতে হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের পর যারা বিজয়ী হয়েছে তারা অতীতের ধারাবাহিকতায় ফিরে গেছে। যারা পরাজিত হয়েছে তারা একবারের জন্য নিজেদের ভুল স্বীকার করে নি। ৭১-এর পর, ৯০-এর পর, এখন ২৪এর পর একই রকম অবস্থা দেখা যাচ্ছে। কেবল শহীদদের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। অথচ গণ-অভ্যুত্থানগুলোর কোনোটিই বিপ্লব নয়, বিদ্যমান কাঠামামোকে বাঁচিয়ে রেখে একটা গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা মাত্র। সামরিক শাসনের মাধ্যমে হোক, আর নির্বাচনের মাধ্যমে হোক— কোনো সরকারই স্বাভাবিক ভাবে, শান্তিতে ক্ষমতা ছাড়তে পারে নি গত ৫০ বছরে। অথচ দেখুন অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো ঠিকই বিজয়ীর বেশে ক্ষমতা ছাড়তে পেরেছে। তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা সুশাসনে। রাজনৈতিক দলগুলো সুশাসন চায় কি না আমার সন্দেহ আছে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর বিকল্প নেই। অনির্বাচিত সরকার কোনো সমাধান নয়। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতান্ত্রিক হতে হবে আগে। সে সম্ভাবনা দেখি না। তাই অন্তবর্তীকালীন সরকারকে অনেক বড় সংস্কার করতে হবে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতা ভাগ করে দিতে হবে। সংসদীয় পদ্ধতির সরকারে প্রধানমন্ত্রী সরকারের নির্বাহী প্রধান হবেন। আলাদা সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। সংসদের ৭০ অনুচ্ছেদ তুলে দিতে হবে। বিচারপতি সিনহাকে যতই দুর্নীতিবাজ বলা হোক না কেন তাঁর পরামর্শ মতো নিম্নআদালতের শৃঙ্খলাবিধি বাস্তবায়ন করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে এমনভাবে সংস্কার করতে হবে তারা নির্বাচন কালে সর্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতা পায়।
দুঃখের বিষয় এসব করলেও গণতন্ত্র নিশ্চিত হবে না, মানুষগুলো যদি ঠিক না হয়। আগের রাতে ভোট করে ফেলা, বিরোধী দলকে বন্দী করে নির্বাচন করে ফেলা— এসব দেখলে যেন নির্বাচন কমিশন লজ্জিত হন, সে ব্যবস্থা রাখতে হবে।
তিন.
অনেকের পছন্দ হবে না, তবুও বলি, সমাজটাকে ইনক্লুসিভ করতে হবে। ‘বহুত্বের সহাবস্থান’ করার দিকে আমাদের এগুতে হবে। গণমানুষ সে দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। অমুক খারাপ আর আমি ভালো— এমূল্যবোধ লালন করে আর বেশিদিন চালানো যাবে না। বাংলাদেশের মানুষ সবাইকে দেখেছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজের আকাঙ্ক্ষা ছাড়ে নি। তাই পৃথিবীতে নেই মানুষ এমন নজির স্থাপন করেছে। অর্ধশতাব্দীতে তিন তিনটা গণঅভ্যুত্থান করেছে। দরকার হলে আরও করবে। মুসলমানদের মধ্যেও নানানরকমের তরিকা আছে। কেউ মাজারকে কেন্দ্র করে ইসলাম ধর্মচর্চা করলে তার সে স্বাধীনতা দিতে হবে। আবার কেউ মাজার বিরোধী হলে সেটা নিজের স্বাতন্ত্র্য রেখে চর্চা করতে পারে। একদল অন্য দলকে আদর্শগত মোকাবিলা করবে নিশ্চিহ্ন করার বল প্রয়োগ করবে না। প্রত্যেক মানুষ তার তার অবস্থানে নিজেকে ঠিক মনে করে। যুক্তি কার্যকর কোনো পন্থা নয়। মনের বিশ্বাসই মানুষের মত তৈরি করে। তাই এক্ষেত্রে সহাবস্থান সমাজের জন্য মঙ্গল।
চার.
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব হবে না। তাই সংবিধান সংশোধন ও আইনগুলো প্রণয়ন করে সকল রাজনৈতিক দলের অঙ্গীকার নিতে হবে। আওয়ামী লীগকেও বাদ দেওয়া যাবে না। স্বৈরশাসক সামরিক মার্কোসের ছেলে ক্ষমতায় এসেছে ৩৪বছর পর, আওয়ামী লীগ তো একটা রাজনৈতিক দল। এদলের ক্ষমতায় ফিরতে ৩৪ বছর লাগবে বলে মনে হয় না। তাই সকল দলের সম্মতি নিতে হবে। কোনো দল সম্মতি ও অঙ্গীকার করতে অস্বীকার করলে তখন সে দল নিজেই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। (আমি এসব লিখতে পারছি। আশা করি অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের পরও যদি বেঁচে থাকি নতুন সরকারের আমলেও লিখতে পারবো)
পাঁচ.
‘নো রিগ্রেটস ফর আওয়ার ইয়ুথ’ আকিরা কুরোসাওয়ার পলিটিকাল ড্রামা। তাঁর অন্য অনেক ছবির মতো বিখ্যাত কিছু নয়। কিয়োটো ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা মাঞ্চুরিয়ার জাপানি আক্রমণের প্রতিবাদ করে। তাদের এক শিক্ষক ইয়াগিহারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বক্তব্যের কারণে চাকরিচ্যুত হন। সে শিক্ষকের মেয়ে ইউকির দুবন্ধু নোগে ও ইটোকাওয়া। দুজনই ওর বাবার ছাত্র। ইটোকাওয়া মধ্যপন্থী আর নোগে তীব্র বামপন্থী। ইউকি নোগের প্রতি দুর্বল।
নোগে সামরিকখলতন্ত্র বিরোধী ‘অ্যাকাডেমিক ফ্রিডম’ আন্দোলনে গ্রেফতার হয়। চার বছরের জেল হয় তার। এক সময়ে ইটোকাওয়া সরকারের প্রসিকিউটর হয়। নোগে জেল থেকে মুক্ত হবার পর ইটোকাওয়াসহ ইউকির বাড়িতে দেখা করতে আসে। নোগে জানায় সে চীন চলে যাবে। ইউকি বুঝতে পারে নোগে অনেক বদলে গেছে। ক্যারিয়ার, বিয়ে এসব নিয়ে সে ভাবছে না। ইউকি কষ্ট পায়। এক সময় সে টোকিও শহরে চলে আসে। একটা চাকরি শুরু করে। তারপর ইটোকাওয়ার মাধ্যমে জানতে পারে নোগে এশহরে আছে। একটা পত্রিকা বের করে। ইউকি নোগের সঙ্গে দেখা করে। নোগেকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। নোগে প্রথমে রাজি হয় না। পরে ওরা বিয়ে করে। জাপান তখন জার্মানির সঙ্গে মিলে যুদ্ধের জন্য উন্মাদ হয়ে ওঠে। নোগে যুদ্ধের বিপরীতে শান্তির উদ্যোগ নিয়ে দাঁড়ায়। সমগ্র দেশ সামরিক খলতন্ত্রের অধীনে যুদ্ধোন্মাদ হয়ে আছে। নোগেকে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতার জন্য গ্রেফতার করা হয়। সেলের ভেতরে (আমাদের আয়নাঘর) পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। ইউকি গ্রেফতার হয় প্রচণ্ড নির্যাতনের শিকার হয়। সরকারি প্রসিকিউটর ইটোকাওয়ার সহায়তায় মুক্তি পায়। ইউকি তার পিতার সংসারে ফিরে যায় না। নোগের দরিদ্র পিতামাতার কাছে ফিরে আসে। গ্রামেও পরিবারটি 'দেশদ্রোহী'র ট্যাগে একঘরে। ওদের কষ্টের ফসলের ক্ষেত নষ্ট করে দেওয়া হয়। বাড়িতে দেশদ্রোহীর পোস্টার লাগানো হয়। একসময় জাপান পরাজিত হয়। হিরোশিমা নাগাসাকি এমনি এক আগস্টে অ্যাটম বোমা মেরে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। অধ্যাপক ইয়োগিহারা চাকরি ফেরত পান। তিনি আবার তাঁর বক্তৃতায় ছাত্রদের বলেন, এক সময় আমরা মনে করেছি নোগে ভুল। আমরা ঠিক। আজ আমরা বুঝতে পারছি, একা হলেও সে-ই ঠিক ছিলো। আমরা সবাই মিলে ভুল করেছি।
ইউকি তার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেয়, মা বলে, তোর জীবন আর সুখের হলো না। ইউকি বলে, আমার স্বামী আমাকে বলেছে সে দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে মা-বাবার খোঁজ নেয় নি। আমার কাজ হলো তাঁদের দেখে রাখা।
এটা সত্য ঘটনা নিয়ে বানানো মুভি। কুরোসাওয়া গোটা ছবিতে পুলিশ, যুদ্ধ, আর্মি দেখান না। কিন্তু তাদের জান্তব উপস্থিতি দর্শক ঠিকই টের পায়। আমাদের এই সময়টা নোগের মতো আত্মত্যাগের। শহীদদের শ্রদ্ধা জানাই। পুলিশের ভ্যান থেকে ফেলে দেওয়া ছেলেটা, জীবন বাঁচাতে পাইপ জড়িয়ে গুলি খাওয়া ছেলেটা, দেয়ালের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে টার্গেটেড গুলিতে মরা ছেলেটা— এরা সবাই আমাদের সন্তান। এক একটা নোগে। কীভাবে এঁদের ভুলবো? ওদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমাদের বহুমত পথের সহাবস্থানের একটি বাংলাদেশ গড়ে উঠুক।
লেখক : প্রফেসর ও উপাধ্যক্ষ
গুরুদয়াল সরকারি কলেজ, কিশোরগঞ্জ