ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী ফেনী সরকারি কলেজে নিয়মতান্ত্রিক উন্নয়ন ঘটলেও পুরনো সংকটগুলো আগের মতই রয়েছে। কলেজে শিক্ষক, শ্রেণিকক্ষ সংকট, নিজস্ব খেলার মাঠ না থাকা, পরিবহন, সুপেয় পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা, নিরাপত্তা বেষ্টনীর অভাব, শিক্ষক ডরমেটরী না থাকা ও পরিপূর্ণ বিজ্ঞান ভবন না থাকা-এসব সংকট এখনো ঘোচেনি। কেবল আশ্বাস মিলেছে।

ইতোপূর্বে ‘ধার করা মাঠে চলে ফেনী কলেজের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা’, ‘নিজস্ব পরিবহন সুবিধা নেই শতবর্ষী ফেনী কলেজে’, ফেনী কলেজে শিক্ষক সংকট: প্রয়োজন ১৮০, আছেন ৭২’ শিরোনামে ধারাবাহিক প্রতিবেদনসহ কলেজের নিছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিতে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ বিষয়ে একাধিক সংবাদ প্রকাশ করেছে দৈনিক ফেনী। তৎকালীন কলেজ কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া আশ্বাস ও পরিকল্পনার কথা জানালেও এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে আওয়ামী সরকারের পতনের পর এসব বিষয় নিয়ে ফের দাবি তুলছেন শিক্ষার্থীরা। সংস্কারের জন্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা অধ্যক্ষ বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছেন৷ শিক্ষার্থীরা বলছেন, কলেজে কিছুই নেই। শতবর্ষী প্রাচীন কলেজ হলেও দৃশ্যমান কোন উন্নয়ন হয়নি। শিক্ষার উন্নয়নের পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকেও নজর দেয়ার দাবি তাদের। কলেজ প্রশাসন বলছে, সব দাবিই যৌক্তিক, প্রাচীন কলেজে এমন সুবিধা না থাকা দুঃখজনক। অচীরেই ধাপে ধাপে সকল সমস্যা সামাধানের উদ্যোগ নেয়ার কথা জানান তারা।

কলেজের বিভিন্ন বিষয়ে কলেজ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সুফিয়ান নোমান বলেন, ২৪ হাজার শিক্ষার্থীর এ কলেজে ১৬টি ডিপার্টমেন্ট তবে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। বিভাগগুলোতে নিয়মিত ক্লাস হয়না, একটি বিভাগে ৪টি বর্ষ বসার মতো পর্যাপ্ত ক্লাসরুম নেই। বিগত সময়গুলোতে আমরা শুধু আশ্বাস পেয়েছি তবে কোন কিছু বাস্তবায়ন হয়নি। বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাবরেটরিগুলো বেহাল দশা, নিরাপত্তা বেষ্টনী ঠিকভাবে নেই। এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি।

কলেজের আরেকজন শিক্ষার্থী শফিকুল আলম বলেন, আমি রসায়ন বিভাগে পড়ি। আমার বিভাগের পেছনে পরিত্যক্ত ডোবা, দুর্গন্ধ। যার কারনে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে পারেনা। অতিরিক্ত মশার কারনে বসতে পারে না। পাশাপাশি ওয়াশরুম সংকট, সুপেয় পানির ব্যবস্থা না থাকা ও ক্লাস রুমের ব্যবস্থা নেই। সব বর্ষের শিক্ষার্থীরা আসলে বসার জায়গা হয় না। এসব সমস্যা সামাধান খুবই জরুরি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ফেনীর সমন্বয়ক ও কলেজ শিক্ষার্থী মোহাইমিন তাজিম বলেন, ইতোমধ্যে অধ্যক্ষলে মৌখিকভাবে ক্যাম্পাসে বহিরাগত প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি জানিয়েছি। পাশাপাশি কলেজের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষক সংকট দূরীকরণ ও বিভিন্ন বিভাগে যে সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলো জানিয়েছি।

তিনি বলেন, ফেনী কলেজে অতীতে নানা সমস্যা থাকলেও কেউ বলতে পারেনি। কলেজ কর্তৃপক্ষ ও ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করেনি। এবার আমরা সাধারণ ছাত্ররা আশা করি দ্রুত বাস্তবায়ন করবে কলেজ প্রশাসন।

এ বিষয়ে শিক্ষক পরিষদ সম্পাদক ফরিদ আলম ভুঞা জানান, শিক্ষক হিসেবে আমরা সন্তুষ্ট না। শিক্ষার্থীরা ও সন্তুষ্ট না। আমরা দীর্ঘদিন কাজ চাকরি করছি আমরাও চাই সংস্কার হোক। যার জন্য দীর্ঘমেয়াদি একজন অধ্যক্ষ প্রয়োজন যিনি পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজগুলো বাস্তবায়ন করবেন।

তিনি বলেন, আমাদের প্রথম লক্ষ্যে পড়ালেখার দিকগুলো উন্নয়ন করে অবকাঠামো উন্নয়নে হাত দেওয়া। তবেই সুন্দর পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব।

অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ এনামুল হক খোন্দকার বলেন, ফেনী কলেজে যোগদান করে বিভিন্ন বিষয়ে অবগত হয়েছি, সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে শিক্ষকদের সাথে পরামর্শ করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হবে। পাশাপাশি শিক্ষার মান বাড়াতেও কাজ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।


কাটেনি শিক্ষক সংকট
ফেনী কলেজে ১৫ টি বিভাগে ২৪ হাজার শিক্ষার্থী থাকলেও এ শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য কলেজে কর্মরত আছেন ৭২ জন শিক্ষক। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পদ সৃষ্টি করার আশা আগে থেকে কলেজ প্রশাসন দিয়ে আসলেও আলোর মুখ দেখেনি সেটি।

জানা গেছে, ১৯৭৯ সালে ফেনী কলেজ জাতীয়করণকালীন ডিগ্রি প্যার্টানে যে শিক্ষকের পদ সৃষ্ট ছিল, তা দিয়েই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর বিষয়ে এখনও পাঠদান চলছে। সময়ের সাথে সাথে কিছু পদ সৃষ্ট করা হলেও অজানা কারণে এনাম কমিটির (এমএল কমিটি) সুপারিশকৃত পদ এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। উক্ত কমিটি জাতীয় বিশ্বাবিদ্যালয়ভুক্ত সকল কলেজের জন্য শিক্ষক পদসংখ্যা সুপারিশ করে।

কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, অধিভুক্ত কলেজগুলোতে প্রত্যেক বিষয়ে পাঠদানের জন্য ১ জন অধ্যাপক, ২ জন সহযোগী অধ্যাপক, ৪ জন সহকারী অধ্যাপক ও ৫জন প্রভাষক সহ মোট ১২ জন শিক্ষক থাকতে হবে। কিন্তু ফেনী কলেজ সূত্রে জানা গেছে, ফেনী কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে সর্বোচ্চ ৭ জন ও অন্যান্য বিভাগগুলোতে ৪ থেকে ৬ জন করে শিক্ষক রয়েছেন।

শিক্ষক সংকট নিরসনে বর্তমান কলেজ প্রশাসনের উদ্যোগ আছে কিনা জানতে চাইলে অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ এনামুল হক খোন্দকার বলেন, শিক্ষকদের এখন কোন শূন্য পদ নেই। পদ সৃষ্টি করে শিক্ষক বাড়াতে হবে। এনাম কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী যে পদগুলো থাকার কথা তার আলোকে মন্ত্রণালয়ে কাজ চলছে। কলেজগুলো থেকে প্রস্তাবনা নেওয়া হয়েছে, আমরা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রস্তাবনা পাঠাব যাতে শিক্ষক বাড়ানো যায়।


নেই নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা
ফেনী সরকারি কলেজ শতবর্ষী কলেজ হলেও এখন পর্যন্ত নেই নিজস্ব পরিবহন সুবিধা। ফেনীর ৬ উপজেলাসহ আশেপাশের জেলাগুলোতে প্রতিদিন হাজার হাজার শিক্ষার্থী এ কলেজে আসা যাওয়া করলেও নিজস্ব পরিবহন সুবিধা না থাকাতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের। এতে নিয়মিত ক্লাস করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এর আগে ভাড়া করা পরিবহনে কিছুদিন কার্যক্রম চললেও সেটি বন্ধ হয়ে যায়। তবে বর্তমান প্রশাসন জানিয়েছেন শিক্ষার্থীদের থেকে আবারও ফান্ড কালেকশন করে বাস ভাড়া নেওয়ার পরিকল্পনা করা হবে।

ইতোপূর্বে ২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কলেজের নিজস্ব পরিবহন সুবিধা না থাকার বিষয়ে সংবাদ করে দৈনিক ফেনী। তখন দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানালেও এখনও আলোর মুখ দেখেনি সেটি।

শিক্ষার্থীরা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কলেজে পরিবহনের চাঁদা দিয়ে গেলেও এখন বাস ব্যবস্থা করা হবে কিনা জানতে চাইলে অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ এনামুল হক খোন্দকার বলেন, এটি একটি বড় কলেজ, ২০ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। প্রতিনিয়ত এখানে পাবলিক পরীক্ষা হয়। প্রতিদিন কুমিল্লা বোর্ড ও জেলাপ্রশাসক কার্যালয় এর ট্রেজারি থেকে প্রশ্নপত্র আনতে হয়। বাসের জন্য যে ফান্ড রয়েছে সেটি দিয়ে কলেজের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহারের জন্য একটি গাড়ি কেনা হবে।

তিনি বলেন, কলেজের একটি গাড়ি প্রয়োজন। কলেজের নিজস্ব অর্থায়নে একটি গাড়ি কেনার কথা মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা আছে। ফান্ড থাকলে কেনার জন্য বলা আছে। শিক্ষার্থীদের জন্য গাড়ি চালুর ক্ষেত্রে আগের মত সে টাকা আবার কালেকশনের ব্যবস্থা করব এরপর ভাড়া করে পরিবহনের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা রয়েছে।


নেই নিজস্ব মাঠ
ফেনী সরকারি কলেজ শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী কলেজ হলেও নেই নিজস্ব খেলার মাঠ। ফেনী সরকারি পাইলট হাই স্কুল মাঠেই আয়োজিত হয় কলেজের সব ধরনের খেলাধুলা। ফেনী কলেজের পেছনের ডোবাটি ভরাট করে খেলার মাঠ করার পরিকল্পনা দীর্ঘদিনের হলেও সেখানে নির্মিত হয়েছে বধ্যভূমি। বধ্যভূমির সামনের অংশটি বালি ধারা ভরাট করা হলেও খেলাধুলার উপযোগী নয়।।ফলে ধার করা মাঠেই শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা করতে হবে।

ইতোপূর্বে ২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ধার করা মাঠে চলে ফেনী কলেজের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে দৈনিক ফেনী। তখন দ্রুত মাঠ নির্মাণের কথা উঠে আসলেও বাস্তবে রুপ পায়নি।।পাশাপাশি তৎকালীন সময়ে সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এ ঘোষণা দিলেও আলোর মুখ দেখেনি সেটি।

এ বিষয়ে কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ এনামুল হক খোন্দকার বলেন, আমাদের যে মাঠ আছে বধ্যভূমির সামনে সেটিকে ব্যবহার করা যায় কিনা দেখব। তবে সম্ভব না হলে আমাদের ছোট অনুষ্ঠান, অভ্যন্তরীণ প্রোগ্রামগুলো নিজের মাঠে করার চেষ্টা করা হবে। এখনও মাঠ আমরা বুঝে পায়নি, এগুলো জেলাপ্রশাসনের আওতাধীন রয়েছে এখনও। সেগুলো বুঝে পেলে আগামী থেকে চেষ্টা করা হবে।


সংস্কারে নেওয়া হচ্ছে উদ্যোগ
কলেজের নিরাপত্তা বেষ্টনী, বিজ্ঞান ভবন নির্মাণ, ছাত্রী হোস্টেলের নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিভাগের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো আলোচনা সাপেক্ষে সামাধান করা হবে বলে জানিয়েছেন কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ এনামুল হক খোন্দকার।

নিরাপত্তার বিষয়ে কাজ হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সীমানাপ্রচীর নির্মাণে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অতিদ্রুত সেটি বাস্তবায়ন হবে।

ভবন নির্মাণের বিষয়ে বলেন, ইতোমধ্যে মসজিদ, বিজ্ঞান ভবন, ডর্মেটরি এবং অকেজো ভবনগুলোকে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন ভবনে পানির সমস্যা রয়েছে, সেজন্য ডিপ টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। সেখান থেকে অন্য ভবনে সংযোগ দেওয়া যায় কিনা আলোচনা হবে। তবে বাণিজ্য ভবনের জন্য একটি টিউবওয়েল এর জন্য আবেদন করা হবে।

তিনি বলেন, কলা ভবন সংলগ্ন রসায়ন বিভাগের বিষয়টি আমার নিজের কাছেই অস্বস্তি লাগে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সেটিকে একটি রূপ দেয়ার চেষ্টা করা হবে। মাটি সরাতে ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে কেমন খরচ হবে সে বিষয়ে আলোচনা করা হবে।

অধ্যক্ষ বলেন, লাল বিল্ডিং ফেনী কলেজের ঐতিহ্য। এটিকে নতুন করে নির্মাণ কিংবা সংস্কার করে মেরামতের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করা হবে। যেখান থেকে প্রয়োজনে রোভার, বিএনসিসি, রেডক্রিসেন্ট ও অন্যান্য কার্যক্রমগুলো পরিচালিত হবে। কলেজ হোস্টেলে সিট বরাদ্দের ক্ষেত্রে কিংবা হোস্টেল বিষয়ে শিক্ষার্থীদের কোন অভিযোগ থাকলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান তিনি।