প্রতি বছরই ফেনীর উত্তরাঞ্চলে ফুলগাজী ও পরশুরামের মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যায় নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ জনপদ। প্রতিবছর বাড়ে বন্যার্ত মানুষের সংখ্যা। বাঁধভাঙা মানুষের স্বপ্নগুলোও একইভাবে ভাঙে। বন্যার পানি নেমে গেলে বাঁধের ভাঙা স্থানগুলো সংস্কারে তোড়জোড় শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। চলতি বছরের তিন দফা বন্যায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভেঙ্গে যাওয়া ৯৫টি স্থান সংস্কারে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে পাউবো।

তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিবছর বাঁধ ভাঙা আর মেরামতের বৃত্তের তাদের জীবন কাটছে। জোড়া তালির বাঁধ সংস্কার তারা আর দেখতে চান না। স্থানীয়রা বলছেন, প্রতি বছর ভাঙন স্থান মেরামতে বিপুল টাকা ব্যয় করা হলেও জলের টাকা জলেই চলে যায়। এতে বাঁধ ভাঙন রোধ হয়নি, স্থানীয়দের দুর্দশাও মেটেনি। বরং বর্ষা মৌসুমে বাঁধের যেকোন স্থান যেকোন সময় ভাঙতে পারে, এ নিয়ে স্থানীয়দের শঙ্কা আজও দূর হয়নি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ড, ফেনীর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ রাশেদ শাহারিয়ার জানান, চলতি বছরের বন্যায় পরশুরাম-ফুলগাজীর ৯৫টি স্থানে নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। মেরামতের জন্য সরাসরি ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ইতোমদ্যে কাজ শুরু করা হয়েছে। পানি শুকিয়ে গেলে পরিপূর্ণ কাজ করা হবে। স্থায়ী ও টেকসই বাঁধ নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মুহুরী, কহুয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্পের পুনর্বাসন’ প্রকল্পটির কাজ শুরু হলে সেটি করা হবে।

স্থানীয়রা জানান, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর মাধ্যমে লোকালয়ে প্রবেশ করে রাস্তা-ঘাট, ফসলি জমি, মাছের ঘের, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তলিয়ে যায়। নিঃস্ব হয় খেটে খাওয়া কৃষক, মৎস্য চাষী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। বন্যার পানি নামলে জোড়া-তালি দিয়ে বাঁধ সংস্কার করে দায় সারে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু দুঃখ দূর হয়না পরশুরাম-ফুলগাজী উপজেলার কয়েক লক্ষাধিক মানুষের।

জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, চলতি বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে তিন দফা বন্যায় পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলায় মানুষের ঘরবাড়ি, কৃষি, ব্যবসা, সড়ক, মৎস ও শিক্ষাখাতে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ঘরবাড়ি হারিয়ে কয়েক হাজার মানুষের জীবনযাত্রা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

স্থানীয়রা জানান, বর্ষা মৌসুমে আতঙ্কে থাকে এসব অঞ্চলের লক্ষাধিক পরিবার। কখন বাঁধ ভেঙে তাদের সব স্বপ্ন পানির নিচে তলিয়ে যায়। ২০২৪ সালে বেড়িবাঁধে ৯৫টি, ২০২৩ সালে ১১ টি, ২০২২ সালে পরপর ৩ দফায় ভাঙন সৃষ্টি হয়। ২০২১ সালে বেড়িবাঁধের ৮ স্থানে, ২০২০ সালে ৬ স্থানে, ২০১৯ সালে ৯ স্থানে এবং ২০১৮ সালে ১৪টি স্থানে ভাঙনে বিপর্যস্ত এসব অঞ্চল।

দৈনিক ফেনীতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মুহুরী-কহুয়া-সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভেঙে পড়া ৬৭ স্থানে মেরামতে গত ৬ বছরে ১০ কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে।

তবে স্থানীয়রা বলছেন, জলের টাকা জলেই গেছে। এতে বাঁধ ভাঙন রোধ হয়নি, স্থানীয়দের দুর্দশাও মেটেনি। টেকস বাঁধ নির্মাণের দাবি এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের। বাঁধ ভাঙলে লাভ হয় তাদের।

ফুলগাজী উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমীর জামাল উদ্দিন চৌধুরী জানান, স্থায়ী ও টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য পুরো বেড়িবাঁধে ব্লক বসাতে হবে। নদী ড্রেজিং করে পানি ধারণ ক্ষমতা স্বাভাবিক করা হলে বন্যা কম হবে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এবারের বন্যায় বাঁধের ভাঙন স্থান সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের জঙ্গলঘোনা গ্রামের সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের ভাঙন কবলিত প্রায় ১শ মিটার বেড়িবাঁধ মেরামত করা হচ্ছে। বাঁধের দুই পাশে বাঁশ গেড়ে মাঝখানে বালু ও মাটির বস্তা ফেলে বাঁধ মেরামত করছে পাউবো।

বাঁধ সংস্কারে নিয়োজিত ঠিকাদার তাজুল ইসলাম জানান, আবার বন্যা হতে পারে। ইতোমধ্যে মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধের ১০টি স্থানে সংস্কার কাজ শুরু করেছি। দ্রুত ভাঙ্গন কবলিত বাঁধগুলো মেরামত করতে হবে। তাই ওয়ার্ক অর্ডার ছাড়াই কাজ করছি। বাঁধ মেরামতের মাটি, বালুসহ অন্যান্য সামগ্রীর সংকট রয়েছে।

চলতি বছরে আবারও মুহুরী নদীর বাঁধ ভেঙ্গে ফের দুর্গতিতে পড়েছেন এ এলাকার মানুষরা। দীর্ঘ বছর ধরে বাঁধ ভাঙ্গা-আর মেরামতের বৃত্তে জীবন কাটছে তাদের। ‘ঢল আইবো আর যাইবো, লাভ অইবো হেতেরগো। আন্ডা মইদ্দে হড়ি পিষি যাইয়ের, ক্ষেত করি আর লাভ নাই। - এভাবে ক্ষোভ ও দুঃখের সঙ্গে নিজেদের অবস্থা প্রকাশ করেন স্থানীয় কৃষক আবদুল খালেক।

পশ্চিম ঘনিয়ামোড়া গ্রামের মিজানুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, বছরের পর বছর দেখে আসছি বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বন্যা হয়। রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ-কালভার্ট, প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্যা নেমে যাওয়ার পর বেড়িবাঁধ মেরামতে হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। নামমাত্র কাজ করে তাদের দায় শেষ।