পানির প্রবল স্রোত এবং মুছাপুর রেগুলেটর না থাকার কারণে সোনাগাজীর চরদরবেশ ইউনিয়নের কাজীর হাটে বিলীন হচ্ছে উপকূলীয় এলাকা। এবারের বন্যায় নদীর পাড়ে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। ফলে ওই এলাকায় বসবাসকারী প্রায় ২০০ পরিবার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। ভিটেমাটি হারিয়ে পথে নামার শঙ্কা বিরাজ করছে তাদের।

স্থানীয়রা জানান, গত কয়েক বছর ধরে নদী ধীরে ধীরে ভাঙছিল। গত একবছরে এই অঞ্চলের ১৫টি পারিবারের বাড়িঘর ভেঙে নদীতে চলে যায়। গত পাঁচ বছরে ৫০টির অধিক পরিবারের ভিটেমাটি নদীগর্ভে চলে গিয়েছে। তাদের ভিটেমাটির চিহ্নটুকুও এখানে নেই। এবারের বন্যায় এ ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। গত ২৬ আগস্ট মুছাপুর রেগুলেটর ভেঙ্গে পড়ার পরপরই প্রবল স্রোত আর বিপরীত দিকে থেকে আসা জোয়ারের পানির তোড়ে নদীর কূলে বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে, মাটি ভেঙে নদীতে তলিয়ে যাচ্ছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দাগনভূঞা সিলোনিয়া এবং মুল ডাকাতিয়া নদী একত্রিত হয়ে ছোট ফেনী নদী কাজীর হাট সংলগ্ন স্থানে বাঁক নিয়ে মুছাপুরে দিকে প্রবাহিত হয়েছে। চরমজলিশপুরের কুঠির হাটের দিক থেকে চরদরবেশের উত্তর চরসাহাভিকারী এলাকার অন্তত ৫০০ মিটার (আধা কিলোমিটার) নদীর তীর ভেঙে তলিয়ে গেছে। নদীর পানি বৃদ্ধি, প্রচণ্ড স্রোত ও ঢেউয়ের আঘাতে নদীর কূল ১৫ মিটার ভেঙে বেড়িবাঁধের দিকে এগুচ্ছে। এতে নদী এবং বেড়িবাঁধের মাঝখানে থাকা পরিবারগুলোর ভিটেমাটি হারাচ্ছে। কোন উপায় না পেয়ে নদীপাড়ের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। ক্রমশ ভাঙনের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় লোকজন বাড়িঘর সরিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছেন।

গত সোমবার এবং মঙ্গলবার ভাঙনপ্রবণ উত্তর চরসাহাভিকারী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় জাকের হোসেন এবং শাহাবুদ্দিন তাদের বাড়ির আঙিনা ভেঙে যাওয়ায় গাছগাছালি কেটে ফেলেছেন এবং রান্নাঘর-গোসল করার ঘর অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন।

ভাঙনের কবলে পড়া শাহাবুদ্দিন বলেন, আমার বসত ঘর কাজীর হাট স্লুইস গেট বেড়িবাঁধের নিচে রয়েছে। গত কয়েক বছর ভাঙলেও নদী ছিলো আমাদের থেকে ৫০ থেকে ৬০মিটার দূরে। তা আস্তে আস্তে ক্রমেই বসত ভিটার দিকে প্রতিবছর এগিয়ে আসছিল। কিন্তু গত ২৬ আগস্ট মুছাপুর রেগুলেটর ধ্বসে পড়ার পর সেদিনই নদীর পাড় ভেঙে যায় অন্তত ৫মিটার। এরপর জোয়ার আর প্রবল স্রোতের ধাক্কায় সেটির আকার বাড়তে থাকে। এতে আমার দুটি বসত ঘরে মধ্যে একটি ঘর তড়িঘড়ি করে সরিয়ে ফেলতে পেরেছি। এখন আর দুটি ভাঙন হলেই পুরো ভিটেমাটি নদীগর্ভে চলে যাবে।

আরেক ভুক্তভোগী জাকের হোসেন বলেন, নদীর বাঁক ধীরে ধীরে বেড়িবাঁধের দিকে এগুচ্ছে। এরআগে গত কয়েক বছরে অনেক বাড়িঘর আমাদের চোখের সামনে নদীতে চলে গেছে। এবারের বন্যায় ভাঙন আরও বেড়ে গেছে। ফলে আমাদের বাড়ির আঙিনা ইতোমধ্যে নদীগর্ভে চলে গেছে। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে ঘরবাড়িসহ বেড়িবাঁধও রক্ষা পাবে না।

ঝুঁকিতে থাকা সুজা মিস্তিরি, খুরশিদ আলম, রফিক মিস্তিরি, জাকেট আহম্মদ, মোঃ দুলাল, মোঃ নাহির জানান, ঘরবাড়ি হারানোর ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারি না। মনে হয়, এই বুঝি ভেঙে নিয়ে গেলো।

খবর পেয়ে ইতোমধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হাসান, সেনাবাহিনীর ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছেন। ইউএনও কামরুল হাসান জানান, ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণে জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীকে বিষয়টি অবগত করা হয়েছে। আশা করছি এই বিষয়ে অতি দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।


নতুন চ্যানেল খননের দাবি
গত কয়েক বছরই সোনাগাজীর চর মজলিসপুর এবং চরদরবেশ ইউনিয়নের নদীর কূল ভাঙছে। এরমধ্যে উপজেলা প্রশাসন এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের উদ্যোগে ভাঙন রোধে জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছিল। তবে স্থানীয়রা বলছেন, এতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। স্থানীয়রা দাবি করেন, নতুন করে জেগে উঠা চরে চ্যানেল খনন করলে নদীর স্রোতের গতি পরিবর্তন হতে পারে।

স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং প্রবীন নাগরিক নাঈম উদ্দিন বলেন, এক সময় নদী বেড়িবাঁধ থেকে দুই কিলোমিটার দূরে ছিল। কাজীর হাট স্লুইস গেট করার পর পূর্ব দিকে নদীর বাঁক করে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে মাঝখানে বিশাল চর জেগে উঠে। চরে এখন মালতা বাগান এবং চাষের জমি হয়েছে। নদী ঘুরিয়ে দেওয়ায় বাঁকে স্রোতের পানি এবং জোয়ারের পানি এসে সরাসরি আঘাত করে এতে ভেঙে যাচ্ছে নদীর কূল। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, গত পাঁচ বছর আগেও এখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা এলে তাদের দাবি জানিয়েছিলাম নদীর গতিপথ ঠিক করতে জেগে উঠা চরে যেনো নতুন চ্যানেল খনন করা হয়। এতে বেঁচে যাবে হাজারো মানুষসহ কাজীর হাট স্লুইস গেট বেড়িবাঁধ। কিন্তু তারা কর্ণপাত করেন নি। যার ফলে এখন তীরে ভাঙণ তীব্র হচ্ছে।

স্থানীয়দের এ দাবির কথা কেউ শুনছে না বলে অভিযোগ করেন ভাঙ্গনে ঘর হারা ভুক্তভোগী শাহাবুদ্দিন। তিনি বলেন, বন্যার পর এখানে পরিদর্শনে উপজেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা এসেছিলেন। কিন্তু তারা ভুক্তভোগীদের কথা না শুনে অন্যান্য মানুষের কথা শুনে চলে যাচ্ছেন। আমাদের সঙ্গে কথা হলে দাবি জানাতাম, আগেই নদীর গতি পথ পরিবর্তন করে বেড়িবাঁধে দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে, এখন নতুন করে জেগে উঠা চরে উপর দিয়ে খনন করে গতি পথ পরিবর্তন করা হলে পানির স্রোত আর এদিকে থাকবে না। কিন্তু আমাদের দাবির কথা কেউ শুনছে না।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও কামরুল হাসান জানান, আমাদের কাজ হচ্ছে এখন ভাঙন প্রতিরোধ করা। জিও ব্যাগ এবং ব্লক দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করা হতে পারে। নতুন চ্যানেল করার বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেই। এটি আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়।