স্যার ক্লাসে প্রশ্ন করতেন- কোন্ রেজি?

সমস্বরে উত্তর আসতো- ইংরেজি।

শ্রদ্ধেয় স্যার ক্লাসে ঢুকেই একটা রিফ্রেশমেন্ট দিতেন, প্রায় ত্রিশ বছর আগের কথা বলছি। এখন বিভিন্ন মটিভেটর যেসব টেকনিক অবলম্বন করেন, স্যার তারচেয়েও বেশী উৎফুল্ল করতে পারতেন।

সর্বজন শ্রদ্ধেয় খুরশীদ স্যার। যদিও তিনি খোরশেদ আলম নামে দাপ্তরিকভাবে পরিচিত। কিন্তু ছাত্রকূলে খুরশীদ স্যার নামেই তিনি বহুল পরিচিত। অসাধারণ প্রতিভা তাঁকে অনেক বেশী ঔজ্জ্বল্য দিয়েছিল। একসময়ের কৃতি ফুটবলার সারাজীবন কিঞ্চিৎ খুঁড়িয়ে হেঁটেছেন ফুটবলের সাক্ষ্য নিয়ে। তাই হয়ত গেমস টিচার না হয়েও ছাত্রদের মাঠে দেখতে পছন্দ করতেন।

চিকন বেত সবসময় হাতে থাকলেও যতটা ছাত্রদের পিঠে ফেলেছেন, তারচেয়ে বেশী হয়েছে ফোঁসফাঁস। বেতের বাড়ি বেশিরভাগই পড়েছে কাঠের টেবিলের ওপর।

তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। কিছুদিন আগে শহরের একটি স্কুলে এক ছাত্র বন্ধুর ফাঁদে পড়ে পশ্চাৎদেশে কলমের সরু অংশ ঢুকে রক্তাক্ত হয়। স্যার ঘটনাটি আমাদের জানিয়ে সাবধান করলেন, বললেন দুষ্টুমি যেন বিপদ ডেকে না আনে। স্যার মনযোগ দিলেন পাঠদানে। এর পরপরই বন্ধু রাজন দাঁড়িয়ে পড়া দিচ্ছিল। যথারীতি আমার কলমটা চলে গেলে তার বসার স্থান বরাবর। রাজন বসতে গিয়েই চিৎকার। বাকীটা ইতিহাস..

ক্লাসে পাশাপাশি বসা দুই বন্ধুর মারামারি দেখলেই স্যার উভয়জনকে ধরে নিয়ে চাপ কলে মাথা ধুইয়ে নিতেন। বলতেন, গরম মাথা ঠান্ডা করি। এরপর নিজের টেবিলের দুইপাশে দুজনের মাথা ঢুকিয়ে চলত শাস্তি। শাস্তির বেশিরভাটাই ছিল কথার বাক্যবাণ।

সবচেয়ে বেশি মজা হত বোর্ড পরীক্ষার ফল এলে। আমাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ফেনী গার্লস হাইস্কুলের সাথে মনস্তাত্ত্বিক খেলা হত প্রথম পাঁচ-জনের প্রাপ্ত নম্বর নিয়ে। কোনো এক অজানা কারনে সবসময় ফেনী পাইলট শীর্ষে থাকত। স্যার খুব মজা পেতেন এবং ছাত্রদের নিয়ে মজায় মশগুল হতেন।

নিয়মিত মাঠ পরিষ্কার, পুকুরের ফেনা পরিষ্কার এমন সব কাজ শিক্ষার্থীর রুটিন কাজ- এ শিক্ষাটা স্যারসহ অন্য সকল শিক্ষক আমাদের দিয়েছেন।

২৫ বছর আগে স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছি। মাঠে এখনও যাই। একসময় যেতাম খেলোয়াড় হিসেবে। এখন যাই সংগঠক হয়ে। তবে মনের গহীনে স্মৃতিগুলো এখনও স্কুলময় রয়ে গেছে। প্রাইমারী স্কুলের গেইট দিয়ে ঢুকতেই তীর্যক চোখে বাম কোণে সেই চাপা কলটি। স্যার এ কালেই গরম মাথাগুলো ঠান্ডা করতেন।

বছর দুয়েক আগে কোনো এক কারণে স্কুলের পরিত্যক্ত দোতলা ভবনে উঠেছিলাম। যদিও ভবনটি আমাদের কাছে চকচকে নতুন। ক্লাসরুমগুলোতে দেয়াল আর ভাঙা কিছু বেঞ্চ চাড়া কিছুই নেই। অথচ স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি কোনো এক স্যার রোল কল করছেন। ইয়েস স্যার, উপস্থিত, হাজির স্যার- নিজের গলা, খুব চেনা কিছু কন্ঠস্বর শুনে হকচকিয়ে উঠেছিলাম। কিছুটা অজানা ভয় আর বিরল সুখানুভূতি এক হয়ে মাথা হতে দেহের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল।

সেদিনও স্যারকে জীবন্ত কল্পনা করেছি, চিকন বেত হাতে সাদা প্যান্ট আর বাটা কোম্পানীর কালো জুতা পরে করিডোরে হাঁটছিলেন।

কুৎসিত কদাকার মাঠ, আবর্জনা আর স্কুলের বিশৃঙ্খলা পরিবেশ দেখে খুব হোঁচট খাই। আমরাতো আরও বেশি দুষ্টুমিতে মেতে থাকতাম। কিন্তু শিষ্টাচার, পরিচ্ছন্নতা আর নিয়মানুবর্তিতা কখনোই একদম ছেড়ে যায়নি। বোধহয় যোগ্যরা চিরবিদায়কালে অনেক কিছুই নিয়ে যান!

গত শনিবার (৯ জানুয়ারি) সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে ফেনী সদর উপজেলার বগইড় গ্রামে ভুঁঞা বাড়িতে মারা যান সবার প্রিয় এ শিক্ষক।

উল্লেখ্য, খোরশেদ আলম স্যার ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৭ এর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ফেনী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও এরপর ২০০১ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ফেনী সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।