হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পে কিংবা জরুরি বিভাগে থাকবে একটি বায়োমেট্রিক মেশিন। অজ্ঞাত রোগী আসার পর সেটিতে তার আঙুলের ছাপ নেওয়া হবে। জাতীয় পরিচয়পত্রে আঙুলের ছাপ থাকার কারণে অজ্ঞাত রোগীর পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত করবে বায়োমেট্রিক মেশিন। এতে দ্রুতই জানা যাবে তার পরিচয়। যোগাযোগ স্থাপন করা যাবে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে।

অজ্ঞাত রোগীদের শনাক্ত করতে এমন ব্যতিক্রমী এক উদ্ভাবন করেছেন চট্টগ্রামের অজ্ঞাত রোগীদের বন্ধু হিসেবে পরিচিত ফেনীর ছেলে প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম নেসার। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে অজ্ঞাত রোগীদের নিয়ে কাজ করছেন তিনি। তার উদ্ভাবিত বায়োমেট্রিক মেশিনের মাধ্যমে দ্রুত অজ্ঞাত রোগী ও লাশের পরিচয় উদ্ধার করে খবর দেওয়া যাবে আত্মীয়স্বজনকে।

তবে পদ্ধতিটি বাস্তবায়নে প্রয়োজন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন। প্রয়োজন সরকারি হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পে একটি করে বায়োমেট্রিক মেশিন স্থাপন করা। সরকারি হাসপাতালে পদ্ধতিটি বাস্তবায়নের দাবিতে প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম নেসার এরই মধ্যে ‘অজ্ঞাতরোগী ও লাশের পরিচয় শনাক্তে চমেক হাসপাতালসহ প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যের মাধ্যমে বায়োমেট্রিক সিস্টেম চালু’ শীর্ষক একটি চিঠি স্বরাষ্ট্র ও আইসিটি মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশন, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারসহ সংশ্নিষ্ট দপ্তরে জমা দিয়েছেন।

সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কিংবা অন্য কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে প্রায় প্রতিদিনই অজ্ঞাত কেউ না কেউ ভর্তি হন। একই অবস্থা দেশের প্রায় সব হাসপাতালের। নামপরিচয়বিহীন এমন অজ্ঞাত রোগীদের নিয়ে হিমশিম খেতে হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। হাসপাতালে এসে অজ্ঞাত অবস্থায় ১০ শতাংশ রোগী মারা যান, সুস্থ হয়ে স্বজনের কাছে ফিরে যেতে পারেন মাত্র ১৫ থেকে ২০ শতাংশ রোগী। এদের একটি বড় অংশই থেকে যায় অজ্ঞাত, পরিচয়বিহীন।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চমেক হাসপাতালে গত এক বছরে তিন শতাধিক অজ্ঞাত রোগী ভর্তি হয় বিভিন্ন বিভাগে। এদের অনেকেই আর পরিবারে বা স্বজনের মধ্যে ফিরতে পারেন না। তবে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি বাস্তবায়ন হলে কমপক্ষে ৮০ শতাংশ পরিচয়হীন রোগী ফিরতে পারবেন স্বজনের কাছে। অজ্ঞাত রোগীদের চিকিৎসায় চমেক হাসপাতালের ২৫ ও ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে ‘অজ্ঞাত রোগী কর্নার’ চালু করেছে হাসপাতাল প্রশাসন।

এ প্রসঙ্গে প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম নেসার বলেন, হাসপাতালে আসা অজ্ঞাত রোগী নিয়ে চিকিৎসক, নার্স, পুলিশ বাহিনী সবাইকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। মর্গে আসা অজ্ঞাত লাশ নিয়েও প্রতিদিন তৈরি হয় জটিলতা। এটি শুধু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সমস্যা নয়, সারাদেশের হাসপাতালগুলোর চিত্র একই রকম। সরকারের আন্তরিকতাই পারে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান দিতে। তিনি বলেন, এই পদ্ধতিতে পুলিশ ক্যাম্পে কিংবা জরুরি বিভাগে থাকবে একটি বায়োমেট্রিক মেশিন। যা দিয়ে অজ্ঞাত রোগীদের নামপরিচয়ও শনাক্ত করা যাবে।

প্রকৌশলী সাইফুল বলেন, বায়োমেট্রিক সিস্টেমকে অজ্ঞাত রোগীর পরিচয় শনাক্তে কীভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে একটি ডায়াগ্রাম তৈরি করি। বিভিন্ন হাসপাতালের পরিচালকসহ বিভিন্ন সেক্টরের অনেকের সঙ্গে এটি নিয়ে শেয়ারও করি। পরে সবার ঐকান্তিক সহযোগিতায় এটি বাস্তবায়িত করি। অজ্ঞাত রোগীদের জন্য উদ্ভাবিত এ পদ্ধতি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনারের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইসিটি মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্নিষ্ট দপ্তরের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। এটি বাস্তবায়ন হলে ১৬ কোটি মানুষ উপকৃত হবে।

নেসারের বায়োমেট্রিক পদ্ধতির বিষয়ে আশার আলো দেখছে হাসপাতাল-সংশ্নিষ্টসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছসেবী সংগঠন ও প্রশাসন।

ফেনী জেলার ছাগলনাইয়ার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম নেসার ১৪ বছর ধরে অজ্ঞাত রোগী নিয়ে কাজ করছেন। ফেনী জেনারেল হাসপাতাল থেকেই অজ্ঞাত রোগীদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন নেসার। এ পর্যন্ত নয় শতাধিক অজ্ঞাত রোগীর পাশে থেকে তাদের সুস্থ করে তুলতে ও পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে কাজ করেছেন তিনি। প্রায় ৩৫০ জন অজ্ঞাত রোগীর পরিচয় শনাক্ত করে পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছেন। অজ্ঞাত রোগীদের নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় ২০১৬ সালে মন্ত্রিপরিষদের পক্ষ থেকে তার হাতে সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়। অজ্ঞাত রোগীদের স্বজনের কাছে ফিরিয়ে দিতে একটি ওয়েবসাইটও করেছেন তিনি। তার কর্মকান্ডের জন্য বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।