বৃহত্তর ময়মনসিংহবাসীর ‘রতন স্যার’ কিংবা ‘রতন দা’ হিসেবে পরিচিত ফেনী জেলা পরিষদের প্রয়াত চেয়ারম্যান ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় রাজনীতিবদ আজিজ আহম্মদ চৌধুরীর ছোট ভাই আমির আহমেদ চৌধুরী আর নেই। বৃহস্পতিবার (১৫ অক্টোবর) রাত সোয়া ১১টার দিকে রাজধানীর শ্যামলীতে বাংলাদেশ বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠক এ মানুষটি।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, আজ শুক্রবার ভোরে তার মরদেহ সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য ময়মনসিংহে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন ও জানাযা শেষে আজ ফেনীতে আনা হবে তার মরদেহ। তবে ফেনীতে এখনো জানাযার সময় নির্ধারণ করা হয়নি। জানাযা শেষে তাকে ফেনীর ফুলগাজীর আনন্দপুর ইউনিয়নের হাসানপুর চৌধুরী বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করার কথা রয়েছে।

তার ভাতিজা ও ফেনী জেলা আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) চৌধুরী আহমেদ রিয়াদ আজিজ রাজীব জানান, গত বুধবার (৭ অক্টোবর) বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা নিয়ে তাকে ল্যাব এইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী শনিবার শ্যামলী বাংলাদেশ বিশেষায়িত হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের তত্ত্বাবধানে তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল। আজ রাত সোয়া ১১টার দিকে সেখানেই মৃত্যু হয়েছে তার। চাচার রুহের মাগফেরাত কামনায় সকলের দোয়া কামনা করেছেন তিনি।

আমির আহমেদ চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৩ সালের ৮ নভেম্বর ফেনীর ফুলগাজীর আনন্দপুর ইউনিয়নের হাসানপুর চৌধুরী বাড়িতে। তবে জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি কাটিয়েছন ময়মনসিংহে। তার তার পড়াশুনা, বেড়ে উঠা সব ময়মনসিংহ ঘিরেই। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। তিনি ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া ১৯৯৬ সালের ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন রতন চৌধুরী। ময়মনসিংহের শিক্ষা, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াঙ্গনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি অবদান রেখেছেন।

১৯৫৬ সালে তিনি সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ১৯৫৮ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯৬০ সালে একই কলেজ থেকে বিএ পাস করার পর ঢাকাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে মেধা তালিকায় নবম স্থান নিয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব এডুকেশন এক্সটেনশন এন্ড রিসার্চ (নায়েম), ঢাকা শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ১৯৯১ সালে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি।

১৯৬৪ সালের আগষ্ট মাসে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে অধ্যাপনার মাধ্যমে শুরু হয় তাঁর শিক্ষকতার জীবন। গৌরীপুর কলেজে তিনি ছিলেন ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে তিনি যোগ দেন মুকুল নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে।

শিক্ষতকতার বাইরেও রাজনৈতিক, খেলাধূলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ছিল সক্রিয় পদচারণা। তাঁর উদ্যোগেই ১৯৫৯ সালে ময়মনসিংহ জেলা মুকুল ফৌজ প্রতিষ্ঠা হয়।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন তিনি। মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে শুরু থেকে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও ময়মনসিংহের গৌরীপুর অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেছেন। আত্মগোপন থাকা অবস্থায় ময়মনসিংহ শহরে মুক্তিযুদ্ধের কর্মকান্ড পরিচালনার সময় পাকবাহিনী কর্তৃক ১৪ নভেম্বর ১৯৭১ হাতে আটক হয়ে অবর্ণনীয় অত্যাচার ও নির্যাতন ভোগ করেন তিনি।

এর প্রায় মাসখানেক আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান তার বড় ভাই ফেনীর সর্বজন শ্রদ্ধেয় রাজনীতিবিদ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আজিজ আহমেদ চৌধুরী। সেসময় ফেনীতে এসে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন আমির আহমেদ চৌধুরী। অংশ নিয়েছিলেন বড় ভাইয়ের শোক, স্মরণ সভাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। বড় ভাইয়ের মৃত্যুর ৩৯ দিনের মাথায় তিনিও চলে গেলেন পরপারে।

এর আগে ২০১৩ সালের ১৯ এপ্রিল মারা যান তাদের ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল আমীন আহমেদ চৌধুরী বীর বিক্রম। চার ভাইয়ের মধ্যে আজিজ আহমেদ চৌধুরী ছিলেন পরিবারের সবার বড়, আমির আহমেদ চৌধুরী দ্বিতীয়, আমিন আহমেদ চৌধুরী তৃতীয় ও আনিস আহমেদ চৌধুরী ৪র্থ সন্তান।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের দাদা শহীদ হোসেন উদ্দিন চৌধুরীসহ পরিবারের ৬সদস্যকে হত্যা করে পাক বাহিনী।

পরিবারের পক্ষ হতে তার আত্মার মাগফেরাত কামনায় সকলের দোয়া কামনা করা হয়েছে।