ফেনীতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় কৃষিখাতে কয়েক হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হলেও তালিকা তৈরিতেই এখনো সীমাবদ্ধ রয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রণোদনা কার্যক্রম। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বন্যার দুই মাস পেরিয়ে গেলেও কৃষক পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের প্রণোদনার জন্য তালিকা তৈরির কাজ এখনো শেষ হয়নি। তবে সরকারি সহায়তার জন্য আশায় বসে না থেকে ঘুরে দাঁড়াতে নতুন উদ্যোমে চাষাবাদ শুরু করেছেন ফেনীর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা। অন্যদিকে মুছাপুর রেগুলেটর বিলীনের প্রভাবে দাগনভূঞা ও সোনাগাজীতে জমিতে পানি জমে থাকায় আগাম চাষাবাদে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানিয়েছেন একাধিক কৃষি কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক একরাম উদ্দিন জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের প্রণোদনার তালিকা তৈরির কাজ চলছে। মুছাপুরে রেগুলেটর ভাঙার কারণে দাগনভূঞা ও সদর উপজেলার কিছু অংশে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। জমিতে পানি ও বৃষ্টি কারণে শীতকালীন সবজি আবাদের অগ্রগতি কম হলেও হাতে দেড় মাস সময় আছে।
তিনি আরও জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় তিন ধাপে ৮৭ হাজার কৃষককে প্রণোদনা দেওয়া হবে। প্রথম ধাপে ২৩ হাজার কৃষককে শীতকালীন সবজির বীজ ও নগদ অর্থ প্রণোদনা দেওয়া হবে। এছাড়া আরও দুই ধাপে শীতকালীন সবজি চাষে ৪৩ হাজার কৃষককে বীজ, সার ও নগদ অর্থ এবং তৈল ও ডাল জাতীয় ফসল চাষে ১২ হাজার কৃষককে বীজ ও সার প্রদান করা হবে। প্রণোদনা প্রদানের জন্য তালিকা তৈরির কাজ চলছে।
কবে নাগাদ তালিকা তৈরির কাজ সম্পূর্ণ হবে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি কৃষি কর্মকর্তারা। তবে দ্রুত এ তালিকা তৈরির কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা পুনর্বাসন বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার জানান, বসতবাড়িতে শাকসবজি চাষের জন্য ৮ ধরনের শীতকালীন সবজির বীজ এবং উৎপাদন ও রোপনের জন্য কৃষক প্রতি এক হাজার টাকা করে প্রণোদনা দেওয়া হবে।
তবে সরকারি সহায়তার আশায় বসে না থেকে ঘুরে দাঁড়াতে নতুন উদ্যোমে চাষাবাদ শুরু করেছেন ফেনীর কৃষি উদ্যোক্তরা। এবারের ভয়াবহ বন্যায় ১৭ একর জমিতে প্রায় ৪ লাখ ৭৬ হাজার টাকা ব্যয়ে আউশ আবাদ নষ্ট হয়ে যায় সোনাগাজীর কৃষক রুবেলের। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও হাল ছাড়েননি এ কৃষি উদ্যোক্তা। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে কোন সহযোগিতা না পেলেও আবার নতুন করে জমিতে আবাদ শুরু করেছি। ইতোমধ্যে জমিতে লাগানোর জন্য টমেটো, মরিচ, ফুলকপি, বাঁধাকপি ও ক্যাপসিকামের চারা তৈরি করেছি। এক সপ্তাহের মধ্যে জমিতে সবজির চারা রোপন করব।
একইভাবে সরকারি কোন সহযোগিতা না পেলেও ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছেন সোনাগাজীর চরচান্দিয়ার আরেক কৃষক মোঃ একরাম হোসেন। তিনি জানান, বন্যায় তাঁর ৭ একর জমির আউশ ধান ও ১০ একর জমিতে লাগানো আমান ধান নষ্ট হয়েছে। এতে তাঁর দেড় লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। তবে ঘুরে দাঁড়াতে ১০ একর জমিতে এবার বিভিন্ন জাতের সবজি চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।
তবে মুছাপুর ক্লোজার বিলীনের প্রভাবে সোনাগাজী এবং দাগনভূঞার কিছু অংশের জমিতে পানি জমে থাকায় আগাম শীতকালীন সবজি চাষ করা যাচ্ছেনা বলে জানিয়েছেন একাধিক স্থানীয় কৃষক।
ধান বীজ তৈরি করে থাকেন ফেনী সদরের পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের কৃষক মির্জা আমিন বাদশা। তবে এবার ধানবীজ উৎপাদন করতে পারবেন কিনা এনিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন এ কৃষক। তিনি জানান, বন্যায় তার তিন একর জমিতে লাগানো আমন ধান নষ্ট হয়ে গেছে। বন্যার পর পানি কমলে আবার ধান লাগিয়েছিলেন, কিন্তু আবারো তা পানিতে ডুবে গেছে। মুছাপুর ক্লোজার না থাকায় পাঁচগাছিয়া ইউপি কার্যালয়ের উত্তর পাশে ও তেমুহনী এলাকায় জমিতে এখনো পানি জমে আছে।
এ ব্যাপারে কথা হলে পাঁচগাছিয়া ব্লকের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা প্রণব চন্দ্র মজুমদার জানান, মুছাপুরে রেগুলেটর ভেঙে জোয়ার-ভাটার প্রভাবে জমিতে এখানে পানি আছে, যার কারণে আগাম চাষাবাদে বিলম্ব হচ্ছে।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, বিক্রির জন্য না হোক, নিজেদের খাদ্যের জন্য হলেও ধান চাষের বিকল্প নেই তাদের।
লেমুয়া ইউনিয়নের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা শিপন চৌধুরী ও ঝন্টু কুমার নাথ জানান, লেমুয়ার কৃষকরা ট্রাক ভাড়া করে কিশোরগঞ্জ, রংপুর, জয়পুরহাট, নেত্রকোনা ও গাইবান্ধা থেকে বিভিন্ন জাতের ধানের চারা কিনে ৩৭০ হেক্টর জমিতে আবাদ করেছেন। এছাড়া এ ব্লকের ৫ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ করা হয়েছে। কিছু কৃষক ইতোমধ্যে লাউ, টমেটো, মুলা ও লালাশাক আবাদ করেছেন কৃষকরা। কিছুদিনের মধ্যে সেসব খাওয়ার উপযোগী হবে।
তিন ধাপে প্রণোদনা পাবে ৮৭ হাজার কৃষক
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় তিন ধাপে ৮৭ হাজার কৃষককে প্রণোদনা দেওয়া হবে। প্রণোদনার প্রথম ধাপে বসতবাড়িতে চাষের জন্য ২৩ হাজার কৃষককে টমেটো, বেগুন, পালংশাক, লালশাক, শিম, লাউ, মিষ্টি কুমড়া ও অন্যান্য শাকের বীজসহ ৮ প্রকার শীতকালীন সবজির বীজ ও নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হবে। এ ধাপে সদর উপজেলায় ৬ হাজার ২০৮ জন, ছাগলনাইয়ায় ২ হাজার ৮৪৮ জন, ফুলগাজীতে ৩ হাজার ২৪০ জন, পরশুরামে ১ হাজার ৮০০, দাগনভুঞাতে ৪ হাজার ২০০ জন এবং সোনাগাজীতে ৪ হাজার ৭০৪ জন প্রান্তিক কৃষক প্রণোদনা পাবেন। এজন্য ৩ কোটি ৫০ লাখ ২৯ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
পরের ধাপে জমিতে শীতকালীন সবজি চাষের জন্যে ৪৩ হাজার কৃষককে বীজ ও ১০ কেজি সার এবং উৎপাদন ও রোপনের জন্য এক হাজার টাকা করে নগদ অর্থ প্রণোদনা দেওয়া হবে।
এছাড়া আমান ধান কাটার পর তৈল ও ডাল জাতীয় শস্য চাষে পাবে ১২ হাজার কৃষককে ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৪০০ টাকার বীজ ও সার প্রণোদনা দেওয়া হবে। গমে ২০০ জন, ভূট্টা চাষে ৫০০ জন, সরিষা চাষে ৫ হাজার, সূর্যমূখী চাষে ৮০০জন, চিনাবাদাম ৮০০জন, সয়াবিন ৪০০, মুগডাল চাষে ৬০০, মসুরের ডাল চাষে ১ হাজার ৫০০জন এবং খেসারি চাষে ১ হাজার ৪০০ জন কৃষককে প্রণোদনা হিসেবে বীজ ও সার প্রদান করা হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক একরাম উদ্দিন জানান, এবার ৫ হাজার ৩৫৫ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৭৩৩ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি ও ২৬ হাজার ৭৬৪ হেক্টর জমিতে আমান ধান আবাদ হয়েছে। এছাড়া বোরো ধান আবাদে ৮০ হাজার কৃষককে প্রণোদনা পাবেন।
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন আক্তার বললেন, ফেনী সদর উপজেলায় ২ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে আমন ধান ও ১৩৪ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রণোদনা কার্যক্রমের তালিকা তৈরির কাজ চলছে।
সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা প্রণব চন্দ্র মজুমদার জানান, এ ব্লকে ইতোমধ্যে ১৭৩ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি আবাদ করা হয়েছে। প্রণোদনা হিসেবে এ ব্লকের ১ হাজার ৫০৪ জন কৃষককে সার ও বীজ প্রদান করা হবে।