৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ।। নিজস্ব প্রতিবেদক ।।

৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। সেদিন সকালটা এসেছিল অন্যরকম ভাবে। ৯ মাসের ভীষন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ক্ষত বিক্ষত, বিধ্বস্ত এ রক্তাক্ত জনপদে সেদিন এসেছিল প্রতিক্ষিত 'মুক্তি'। অনেক রক্তের স্রোতে ভেসে, অনেক আত্মত্যাগ- গণহত্যার শোক বুকে নিয়ে এ মাটিতে উড়েছিল স্বাধীন এক লাল সবুজ বিজয় নিশান- আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার, আমাদের অস্তিত্ব- স্বাধীনতা। সেদিন সকালে ঘুম ভেঙেছিল সকলের সচকিত হয়ে,  সেইদিন সুর্য উদিত হয়েছিল রক্ত জাগানো সেই অমর শব্দমালা শুনে- 'জয় বাংলা'। দিকে দিকে ধ্বনি প্রতিধ্বনিতে এ জনপদে বিজয়ের কোরাস।

পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ৯ মাসের বন্দিদশা থেকে সেদিন সকালে মুক্তির নিঃশ্বাস নিয়েছিল মানুষেরা দরজা খুলে প্রথমবার। সকল পরাধীনতার গ্লানি মুছে সেদিন মুক্তির মিছিলের গণজোয়ারে জয় বাংলা ছাড়া অন্য কিছু শোনা যায়নি আর। সেদিন ছিল ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ প্রথম সকাল- প্রিয় স্বাধীনতার। আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন।

বিলোনিয়া যুদ্ধে নিহতদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ, পরশুরাম

ফেনী মুক্ত দিবস আজ ৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তান-হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনীকে হটিয়ে ফেনীকে দখলমুক্ত করে স্বাধীন ঘোষণা করা হয়। ওইদিন সকাল থেকে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা লেঃ কর্নেল জাফর ইমামের (বীর বিক্রম) নেতৃত্বে দলে দলে লাল সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে ফেনী শহরে প্রবেশ করে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে শুরু করেন।

৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনীর হাতে জিম্মি ছিল ফেনী। ফলে সেদিন সকালে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শুনে অনেকেই হকচকিত হয়ে ওঠেন। অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের এ স্লোগান প্রথম বিশ্বাসই করতে পারেননি- সত্যিই আমরা স্বাধীন হয়েছি। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের মিছিলে দেখতে পান। তখন লোকজনের ভুল ভাঙতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সাধারণ মানুষ মিছিলে যোগ দিতে শুরু করেন। বর্তমান শহীদ হোসেন উদ্দিন বিপনী বিতানের সামনে রাজাঝির দীঘির ওঠার রাস্তার পাশে ফেনীতে প্রথম ‍ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা।

 

অসামান্য বীরত্বগাথাঃ

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ফেনী জেলার (তৎকালীন ফেনী মহুকুমার) স্বাধীনতাকামী জনগনের রয়েছে অভাবনীয় বীরত্বগাথা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথে তিন দিক থেকে ফেনীর রয়েছে সীমান্ত। ফলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ফেনীতে ব্যাপক অত্যাচার নিপীড়ন ও নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। ফেনী সীমান্তে মুক্তিযুদ্ধের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। এর মধ্যে শুভপুর ও বিলোনিয়া যুদ্ধ অন্যতম।

মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিসৌধ, জেল রোড, ফেনী।

মরহুম খাজা আহমদের নেতৃত্বে ফেনীর মুক্তিযোদ্ধারা দেরাদুন ও চোত্তাখোলায় প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন ২নং সাব-সেক্টর কমান্ডার জাফর ইমামের নেতৃত্বে বিলোনিয়া যুদ্ধ একটি অনন্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। যার রণকৌশল বিশ্বের বিভিন্ন মিলিটারী একাডেমীতে পাঠ্যক্রম ভুক্ত। যা এ রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের অংহকার আর গর্বের বিষয়। এ এ কে জেনারেল নিয়াজী তার বই ‘‘THE BETRAYAL OF EAST PAKISTAN’’  বইতে স্বীকার করে লিখেছেন যে, ‘A Brigade action which launched at Belonia was repulsed.” বিলোনিয়ার ২য় যুদ্ধে ১৩৭ জন যোদ্ধা সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন, আহত হন আরও অন্তত ২০০জন।

ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক জয়নাল আবদীন ভিপি’র নেতৃত্বে এ অঞ্চলে আরেকটি মুক্তিবাহিনী ছিলো বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী নামে। তারা দাগনভূঞা, রাজাপুর, সিন্দুরপুর হয়ে হানাদার বাহিনীকে টানা আক্রমণ করতে করতে ফেনী শহরের দিকে এগুতে থাকে।

এক পর্যায়ে পাক হানাদাররা ৬ ডিসেম্বর রাতে কুমিল্লার দিকে পালিয়ে পায়। সে সময় ফেনীর অবাঙালি মহকুমা প্রশাসক বেলাল এ.খানও পাকবাহিনীর সঙ্গে পালিয়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য ফেনীর ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত করা হয়। খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে শহীদ মেজর সালাহ উদ্দিন মমতাজ, শহীদ সুবেদার ফয়েজ আহম্মদ, সুলতান মাহমুদ, আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীকে বীর উত্তম, জাফর ইমাম, আমিন আহম্মেদ চৌধুরী, আবদুস সালাম, এয়ার আহমদ, নুরুল ইসলাম, ভুলু মিয়া, রমজান আলী এই ৭ জন বীর বিক্রম এবং আরও ২০ জন বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন।

 

ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বধ্যভূমিঃ

দীর্ঘ নয় মাসের রক্তঝরা স্বাধীনতা সংগ্রামে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের নৃশংশ বর্বরোচিত অত্যাচার - গণহত্যা - মা বোনদের ধর্ষণ সহ ধংসাত্মক কর্মকাণ্ডে ক্ষতবিক্ষত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা ফেনী জেলার বিভিন্নস্থানে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। লাশ ফেলা হয় পুকুর, খাল, নদী , ডোবা-নালায় ও গভীর জঙ্গলে। অগণিত মানুষকে রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানীরা ধরে নিয়ে শহরের দাউদপুর ব্রিজ থেকে নির্মমভাবে গুলি করে খালে ফেলে দেয়। ফেনী কলেজের পূর্ব ও দক্ষিণ পাশে অগণিত মানুষকে ধরে এনে মাটি চাপা দেয়া হয়। স্বাধীনতার পরে সেখানে পাওয়া যায় মানুষের কংকাল, মাথার খুলি, হাড়গোড়।

ফেনীর বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ফেনী সরকারী কলেজ এলাকার বধ্যভূমি, দাগনভূঁঞার রাজাপুর স্কুল এন্ড কলেজ সংলগ্ন চৌধুরী বাড়ির পার্শ্বে অরক্ষিত বধ্যভূমি, ফুলগাজীর জামুড়া গ্রামের বধ্যভূমি, পরশুরামের মালিপাথর বধ্যভূমি ও একই উপজেলার সলিয়া বধ্যভূমি উল্লেখযোগ্য। এসব বধ্যভুমি ছাড়াও শত সহস্র শহীদের রক্তে রঞ্জিত এ মাটি।সস্বাধীনতার ৪৮ পার হলেও বেশির ভাগ গণকবর চিহ্নিত হয়নি। সংরক্ষন তো দুরের কথা।

পরশুরামের সলিয়ায় বীর শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ

সময়ের সাহসী অগ্নিদিপ্ত পুরুষ যারাঃ

সৈনিক, কৃষক, মজুর, শ্রমিক ছাত্র জনতার সম্মিলিত প্রয়াসে সকল গণযোদ্ধারা অবদান রেখেছেন যুদ্ধের সকল পর্যায়ে, ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ। ফেনীর মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছেন সাংগঠনিক নেতৃত্বদানকারি ফেনীর মুকুটহীন সম্রাট খ্যাত মরহুম খাজা আহম্মদ এমপি। ২৭ মার্চ ১৯৭১ তার নেতৃত্বে পূর্ব উকিল পাড়ার একটি বাসায় ১১ জন কুরআন শপথ গ্রহণ করে দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমরণ যুদ্ধ করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন। এই ১১ জনের নেতৃত্বে একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তার মধ্যে ছিলেন এবিএম তালেব আলী, আবদুর রহমান বিকম, আবদুল মালেক, রফিকুল হক, ইউনুছ চৌধুরী, মোস্তফা হোসেন, রুহুল আমিন, নুরুল হুদা, একেএম শামসুল হক প্রমুখ।

সামরিক নেতৃত্বদানকারি ২নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার ও যুদ্ধকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১০ম ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা সিও লেঃ কর্নেল অবঃ জাফর ইমাম বীরবিক্রম, মেজর জেনারেল হেলাল মোরশেদ বীরবিক্রম, কর্নেল ইমাম উজজামান বীরবিক্রম,  ক্যাপ্টেন মিজান এবং মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর একট অংশের গেরিলা কমান্ডার ভিপি জয়নালসহ আরো অনেকে।

মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদদের স্মরণে সোনাগাজীর স্মৃতিসৌধ

ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহযোগিতাও কোন অংশে কম নয়। ঋণী আমরা সকলের কাছেই। আমরা তোমাদের ভুলবো না। আজ শ্রদ্ধাবনতভাবে স্মরন করি সেই সব অকুতোভয় বাংলা মায়ের সেইসব সন্তানদের যারা অকাতরে প্রান দিয়েছেন, সেই সব মুক্তিযোদ্ধাদের যাদের হাত ধরে পেয়েছি স্বাধীনতা, সেই সব শহীদদের যাদের বীরত্বগাথা মুখে মুখে ফেরে, সেই মা বোনদের যারা সম্মান হারিয়েছেন, সন্তান হারিয়েছেন, ভাই হারিয়েছেন, আপনজন হারিয়েছেন। অনেক কষ্ট ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা, সে এক অমুল্য ধন। বিজয়ের এই দিনে সকলকে জানাই দৈনিক ফেনীডটকমের পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন।