‘মানুষের জীবনের শেষ ঠিকানা মৃত্যু, আর সে মৃত্যুর পরে জায়গা হয় সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে। আর আমাদের কবরের জন্য সে জায়গাটুকুও নেই, মাথা গোঁজার মত একটি আশ্রয় নেই, গাছ তলায় দাঁড়ালেও আমাদের প্রশ্ন করা হয় কেন দাঁড়িয়েছি এখানে। ’
এভাবেই কান্না জড়িত কন্ঠে নিজেদের সামাজিক অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গির কথা কান্নাজড়িত কণ্ঠে দৈনিক ফেনীর প্রতিবেদকের কাছে ব্যক্ত করছিলেন ফেনীর তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের একজন রুমি হিজড়া।
আজ বুধবার (১৮ নভেম্বর) দুপুর ১২ টায় জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের আয়োজনে শহরের একটি কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজিত ‘তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জীবন মান, উন্নয়নে প্রয়োজন সবার অংশীদারিত্ব’ বিষয়ে মানুষ মানুষের জন্য শিরোনামে আয়োজিত সেমিনারে অনুষ্ঠানে বক্তব্যে প্রদানকালে এভাবেই নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা। আত্মস্বীকৃতি ও সামাজিক মর্যাদা চাওয়ার বিষয়গুলো তাদের বক্তব্যে উঠে আসে।
রুমি বলেন, আমরা রাস্তা দিয়ে গেলে মানুষ হাসে৷ কোন বাড়িওয়ালা আমাদের বাসা ভাড়া দেয় না। আমাদের ভাড়া দিলে অন্য ভাড়াটিয়ারা ভাড়া নিবেনা। আমরা কোথায় থাকবো তাহলে সে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, সরকার আমাদের কর্মসংস্থানের ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করার কথা বলেছে, কিন্তু তা এখনো বাস্তবায়ন করেনি।
মমতা নামে আরেকজন বলেন, সবার কাছ থেকে আমরা খারাপ ব্যবহার পাই। মানুষের কাছ থেকে চেয়ে ৫ টাকা নিয়ে আমরা খাই, কিন্তু তারা যদি আমাদের না দেয় তখন তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে বাধ্য হই। কারণ একজন মানুষের ৫ টাকা সহযোগিতা আমাদের একবেলা ভাত জোগাড় করতে পারি। তাদের সহযোগিতা না পেলে আমরা কিভাবে দুইবেলা ভাত খাবো। আমাদের তো কাজ করার সুযোগ নেই, যেখানেই যাই আমাদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হয়।
কবিতা হিজড়া নামে অন্য একজন বলেন, অনেকে অভিযোগ করে বলে আমরা নাকি বিয়ে বাড়িতে গিয়ে জোর করে টাকা আদায় করি। এটা মিথ্যা কথা। তিনি বলেন, আমরা যখন শুনি কোন জায়গায় বিয়ে হচ্ছে বা নতুন সন্তান জন্ম নিয়েছে আমরা খুশী হয়ে তাদের কাছে যাই। অনেকেই আমাদের খুশী হয়ে টাকা দেয়। আবার অনেকে তাড়িয়ে দেয়৷
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বিয়েতে বড়লোকরা লাখ লাখ টাকা খরচ করে কিন্তু আমরা ১-২ হাজার টাকা চাইলে আমাদের দেয়না। মানুষ যদি আমাদের সহযোগিতা না করে আমরা কি খেয়ে বেঁচে থাকব প্রশ্ন করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, আমরা নিজেরাই গরীবের বিয়ের জন্য সহযোগিতা করি অনেক সময়।
আশা হিজড়া নামে আরেকজন বলেন, আমরাও মানুষ, মা-বাবার সন্তান। তিনি বলেন, আমাদেরকে ফেনীর মানুষ সম্মান করে৷ কিন্তু আমরা কোন প্রাইভেট হাসপাতালে টাকার বিনিময়ে চিকিৎসা নিতে গেলে চিকিৎসা দেয়া হয় না৷ আমাদেরকে দেখলেই তাড়িয়ে দেয়। তিনি বলেন, আইন তো সবার জন্য সমান। আমাদেরও চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু আমরা বঞ্চিত হই সবকিছু থেকে। আশা বলেন, আমরা যারা পড়ালেখা জানি না, তারা কিভাবে চাকরি করবে৷ যারা পড়ালেখা পারে তারা চাকরি করবে, কিন্তু আমরা যারা পড়ালেখা জানিনা তাদের তো ভিক্ষা করতে হবে।
ফেনীতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের দাবি প্রসঙ্গে জেলার প্রধান সমন্বয়ক সুন্দরী হিজড়া বলেন, আমাদের নিজস্ব কবরস্থান ও বাসস্থানের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি। আমাদের আশ্রয় দরকার মাথা গোঁজার জন্য। আমাদের জেলার এমপি মহোদয় ও জেলা প্রশাসন থেকে আমাদের বলেছে দাবিগুলো পূরণ করা হবে। আমরা শীঘ্রই এ তার বাস্তবায়ন দেখতে চাই।
লিপি নামে আরেকজন বলেন, অন্যদের তুলনায় ফেনীতে আমরা অনেক ভালো আছি। কিন্তু সারাদেশে বিশৃঙ্খলা হচ্ছে হিজড়াদের নিয়ে। তিনি বলেন, আমাদের নিয়ে ফেনীতে বিশৃঙ্খলা নেই।
তাদের দাবির প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক মোঃ ওয়াহিদুজজামান তাদের জন্য কবরস্থান, বাসস্থানসহ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার আশ্বাস প্রদান করেন। এছাড়াও তাদের যাবতীয় সমস্যাগুলো সামাধানের আশ্বাস দেন এবং দিক নির্দেশনামুলক পরামর্শ দেন।
উল্লেখ্য, ফেনীতে প্রায় ১৫০জন তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে, যারা ফেনীর বিভিন্ন উপজেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করেন।