সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পুনর্বাসন ও জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিবছরের ন্যায় এ শ্রেণির শিশুদের উন্নয়নে সরকার নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও ফেনীতে পথশিশুদের সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই। সরকারিভাবে নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও ফেনীর বিভিন্ন স্বে”ছাসেবী সংগঠন ও সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্যমতে, ফেনীতে পথশিশুদের মধ্যে ৪০ শতাংশের বেশি মাদকাসক্ত, ২০ শতাংশ চুরি-ছিনতাইয়ে জড়িত, ৪২ শতাংশের বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ অসু¯’ হলে দেখার কেউ নেই এবং ১০ শতাংশ অসু¯’ হলে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করতে পারে না।

একই সূত্রমতে, ফেনীতে অব¯’ানকারী পথশিশুদের বেশিরভাগ লাকসাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খুলনা, লক্ষীপুর, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী হতে এসেছে। সড়ক পথে যাতায়াত এবং আবাসনের জন্য তুলনামূলক সুবিধাজনক হওয়ায় এখানে ভাসমান শিশুরা সহজে জায়গা করে নেয়। তবে তারা একই ¯’ানে দীর্ঘসময় ¯’ায়ী হয় না।

জেলায় পথশিশুদের কোনো পরিসংখ্যান নেই বলে জানান জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর, পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং মহিলা ও শিশু অধিদপ্তর। এ প্রসঙ্গে জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাইফুল ইসলাম জানান, পথশিশুদের পরিসংখ্যানের জন্য কোনো জরিপ আমাদের নেই। তবে সরকারিভাবে কিছু উদ্যোগ বাস্তবায়িত হ”েছ।

একই প্রসঙ্গে জেলা পরিসংখ্যান ব্যুরোর উপ পরিচালক গৌতম কৃষ্ণ পাল বলেন, ভাসমানদের তথ্য জানতে আরও ২ মাস সময় লাগতে পারে।

জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান শরীফ বলেন, পথশিশুদের নিয়ে আমাদের এ ধরনের জরিপ নেই। বিভিন্ন এনজিও এবং পরিসংখ্যান ব্যুরো এ বিষয়ে কাজ করতে পারে। একই কথা বলেন জেলা মহিলা ও শিশু অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নাসরিন আক্তার।

স্বে”ছাসেবী সংগঠন সহায়’র সভাপতি মঞ্জিলা মিমি বলেন, সুবিধাবঞ্চিত হওয়ায় পথশিশুদের মধ্যে হতাশা কাজ করে। এ কারণে খুব সহজে তাদের প্রভাবিত করা যায়। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ৬ থেকে ৭ বছর পার হওয়ার পর থেকেই মেয়ে পথশিশুদের নানা যৌনকর্মে লিপ্ত করা হ”েছ।

পথশিশুদের পুনর্বাসন এবং শিক্ষায় কোন উদ্যোগ রয়েছে কিনা জানতে চাইলে মিমি বলেন, ফেনী শহরের পথশিশুদের জন্য রেলওয়ে স্টেশন প্লাটফর্মে একটি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। সরকারি সহায়তা না পাওয়ায় তা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া ব্যবহৃত ¯’ানটিতে এখন রেলওয়ের অফিস করা হয়েছে। তিনি বলেন, শহরের সবচেয়ে বেশি পথশিশুর অব¯’ান রেলওয়ে স্টেশন, তারপর মহিপাল, বিভিন্ন বস্তি, ভাঙ্গারি দোকান ও বাসস্টপেজগুলোতে।

অপরাধ নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগের কথা তুলে ধরে ফেনী পুলিশ সুপার জাকির হাসান বলেন, পথশিশুদের তথ্যসংগ্রহের একটি প্রক্রিয়া চলছে। অপরাধ জগৎ থেকে তাদের দূরে সরিয়ে আনতে কাউন্সিলিং করা হবে। এছাড়া শহরে সিসি টিভি বসানোর কাজ সম্পন্ন করা গেলে নানা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

পথশিশুদের নিয়ে সরকারের মাঠ পর্যায়ে সহায়তার কথা উল্লেখ করে সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, জেলায় ৬ জন পথশিশুকে প্রতিমাসে ২ হাজার টাকা করে দেয়া হ”েছ। এছাড়া চাইল্ড প্রটেকশন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইউনিয়ন পর্যায়ে পরশুরামের মির্জানগর ইউনিয়নে সমাজভিত্তিক শিশু সুরক্ষা কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এদিকে পরিকল্পিত ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়তে পথশিশুদের বিষয়ে আরও সচেষ্ট হওয়ার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।


জন্মনিবন্ধন না থাকায়
নাগরিক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ফেনীর বেশিরভাগ পথশিশুদের জন্ম নিবন্ধন সনদ নেই। যার কারণে তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে না। এছাড়া বঞ্চিত হ”েছ নাগরিক সুবিধা থেকেও।

রেলওয়ে স্টেশনের ভাসমান শিশু মিরাজের বাবা তোফায়েল বলেন, রিক্সা চালিয়ে দীর্ঘবছর এ প্লাটফর্মে থাকি। আমার ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকার এনআইডি থাকলেও সন্তানের জন্ম সনদ করতে পারিনি। এখানে সরকারি তেমন সুযোগ সুবিধাও পাইনা। এছাড়া গতবছর সবচেয়ে বড় কথা সন্তানকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে গিয়েও এ ঝামেলায় পড়ে ফিরে আসতে হয়েছিলো।

পথশিশুদের জন্মনিবন্ধন প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে পৌরসভার স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ডা. কৃষ্ণপদ সাহা বলেন, ¯’ানীয় কাউন্সিলর থেকে একটি প্রত্যয়নপত্র নিয়ে আসলে জন্মনিবন্ধন সনদ দেয়া হ”েছ। আগের মতো এখন আর মা-বাবার এনআইডির প্রয়োজন হ”েছ না।

জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন পাটওয়ারী বলেন, ভাসমানদের এনআইডি প্রদানের ক্ষেত্রে সচরাচর ¯’ায়ী বাসিন্দা হতে হয়। সেক্ষেত্রে একটি পলিথিনে মোড়ানো ঘর হলেও হবে। তবে সাম্প্রতিককালে রোহিঙ্গা সমস্যায় পিতা-মাতার এনআইডি এবং অনলাইন জন্মসনদের ফটোকপিও সংযুক্ত করতে হ”েছ।

উল্লেখ্য চলতি বছরের ১২ জুন পথশিশুদের জন্ম নিবন্ধন সনদ দেয়ার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করা হয়।

‘চাহিদা মিটলে অপরাধ কমবে’
ড. মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম
ভাসমান পথশিশুদের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করা গেলে সমাজের নানা অপরাধ জগৎ থেকে তাদের ফেরানো সম্ভব হবে বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম। তিনি বলেন, সমাজ উন্নয়ন হলে ও মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়লে দরিদ্র কমে যাবে। তখন পথশিশুর সংখ্যাও কমবে। তবে এ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান থাকা জরুরি।

চাহিদাগত দিক আচরণকে প্রভাবিত করে উল্লেখ করে দৈনিক ফেনীকে তিনি বলেন, চাহিদা না মিটলে আচরণগত দিক থেকে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ শ্রেণির শিশুরা তখন শিশুশ্রম অথবা ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে। তবে ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমেও অনেকে অপরাধ জগতের অংশ হয়ে যায়।