শতবর্ষ পূর্ণ করেছে বৃহত্তর নোয়াখালীর প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফেনী সরকারি কলেজে। ১৯২২ সালের ৮ আগস্ট একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করে কলেজটি। প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষ্যে গতকাল সোমবার (৮আগস্ট) সকালে কলেজ প্রাঙ্গন হতে কলেজ প্রশাসনের উদ্যোগে আনন্দ র‌্যালী ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। র‌্যালীটি শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে কলেজে এসে শেষ হয়। র‌্যালীতে অংশ নেন শিক্ষক-শিক্ষিকা, বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা- কর্মচারী ও ছাত্র নেতৃবৃন্দ। তবে শোকের মাস হওয়ায় সীমিত পরিসরে দিবসটি আয়োজন করে কলেজ প্রশাসন।

শতবর্ষ উপলক্ষ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা, বধ্যভুমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের, ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানায় কলেজ প্রশাসন। পাশাপাশি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জন্মদিনে তার প্রতিকৃতিতেও শ্রদ্ধা জানানো হয়।

ভৌগলিক ও অবস্থানগত কারণে ফেনী সরকারী কলেজের গুরুত্ব বাংলাদেশের দক্ষিণ পুর্বাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের নিকট অপরিসীম। শতবর্ষ পূর্ণ করায় কলেজের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী, শিক্ষক,কর্মকর্তা, কর্মচারীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ বিভিন্ন মাধ্যমে কলেজকে নিয়ে নিজের আবেগ ভালোবাসার ও স্মৃতিময় কথা তুলে ধরছেন অনেকেই। ইতোমধ্যে শতবর্ষপূর্তি উদযাপন করার প্রস্তুতি হিসেবে শতবর্ষ উদযাপন পরিষদ গঠন করা হয়েছে। যার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

এই কলেজ থেকে পড়ুয়া অনেক গুণীজন দেশের শীর্ষ স্থানে রয়েছেন। অনেক শিক্ষক এই কলেজ থেকে নিজে পড়ছেন আবার পড়িয়েছেন, কেউ কেউ এখনও পড়াচ্ছেন। সেই সাথে ভাষা আন্দোলন সহ মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের এই কলেজের ছাত্রদের ছিল অগ্রণী ভূমিকা। জেলার শ্রেষ্ঠ কলেজ হওয়ার পাশাপাশি বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রথম পছন্দের কলেজ এটি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে কয়েকবার ২য় সেরা কলেজ নির্বাচিত হয়েছে ফেনী সরকারি কলেজ।

১৯২২ সালে ফেনী কলেজ যখন যাত্রা শুরু করে তখন বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ফারসি, সংস্কৃত, গণিত, ইতিহাস ও যুক্তিবিদ্যা বিষয়ে ১৪৬ জন শিক্ষার্থী নিয়ে আই.এ ক্লাস চালু করা হয়।বর্তমানে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে উচ্চ মাধ্যমিক শাখা ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৫টি বিভাগে স্নাতক-স্নাতকোত্তর (সম্মান), ৪টি বিষয়ে স্নাতক(পাস)কোর্স সর্বমোট ২৪ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছে।

উল্লেখ্য, ১৯১৮ সালের দিকে কলেজটি প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও ১৯২২ সালে তৎকালীন সময়ে খান বাহাদুর বজলুল হক একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেন এবং তখন থেকেই মূলত কলেজটির যাত্রা শুরু হয়। ফেনী সরকারি কলেজটি যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন বৃহত্তর নোয়াখালীতে এটিই ছিল উচ্চশিক্ষার একমাত্র প্রতিষ্ঠান। ২য় বিশ্ব যুদ্ধ সহ দেশের বিভিন্ন ইতিহাসের সাথে এই কলেজের নাম জড়িত।

শতবর্ষে শিক্ষার্থীদের আশা-আকাঙ্খা

শতবর্ষী এই কলেজে দিনে দিনে শিক্ষার মান উন্নয়নের পাশাপাশি অবকাঠামোগত ও সৌন্দর্য বর্ধনের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের রয়েছে অনেক আক্ষেপ এবং চাওয়া। কলেজে ইতোমধ্যে চালু হয়েছে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা ছাত্রী হোস্টেল। ছাত্র ছাত্রীদের জন্য আছে আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব,আছে বায়োমেট্রিক হাজিরার ব্যবস্থা তবে দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ রয়েছে সেটি।

ছাত্রছাত্রীরা কলেজের নিজস্ব একটি খেলার মাঠের দাবী জানিয়ে আসছে বহুবছর ধরে কিন্তু এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। পাশাপাশি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান চর্চা ও হাতে কলমে শিক্ষার জন্য নেই উন্নত মানের ল্যাবরেটরি। কলেজের রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থীদের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করার জন্য প্রয়োজন আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন ল্যাবরেটরি। শিক্ষার্থী অনুপাতে ল্যাবরেটরিতে পর্যাপ্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকায় বিজ্ঞান চর্চায় এই কলেজের শিক্ষার্থীরা অনেকটা পিছিয়ে আছে।

শিক্ষার্থীদের দাবী দ্রুত কলেজের মাঠ নির্মাণ। পাশাপাশি আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন ল্যাবরেটরি ও বিজ্ঞান চর্চার সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর দাবী জানান শিক্ষার্থীরা। বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের ল্যাবে আধুনিক কোন ব্যবস্থা নেই। যার কারনে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস ঠিকঠাক হয়না আমাদের শিখনিতেও ঘাটতি থেকে যায়।

কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর বিমল কান্তি পাল জানান, কলেজের নিজস্ব খেলার মাঠের জন্য আমরা অনেক আগে থেকেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। বধ্যভূমির পাশে পুকুরটিতে কচুরিপানা সরিয়ে বালু ফেলে মাঠ করার জন্য শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নিকট আবেদন পাঠিয়েছি, এখনও কোন বরাদ্দ না আসাতে মাঠ নির্মাণ সম্ভব হচ্ছেনা।

আধুনিক ল্যাবরেটরি স্থাপনের বিষয়ে অধ্যক্ষ বলেন, পরিপূর্ণ ৬তলা বিশিষ্ট একটি বিজ্ঞান ভবনের জন্য অনেক আগেই আবেদন করা আছে। করোনার কারনে সে আবেদনের বরাদ্দ স্থবির হয়ে গেছে,কলেজ প্রশাসন চেষ্টা করছে দ্রুত যাতে বরাদ্দ আসে। তিনি বলেন, বরাদ্দ আসলে পরিপূর্ণ একটি বিজ্ঞান ভবন হবে পাশাপাশি বিজ্ঞান চর্চার জন্য আধুনিক ল্যাবরেটরি ও স্থাপন করা হবে। শিক্ষার্থীরা হাতে কলমে শিক্ষা নিতে পারবে।

বায়োমেট্রিক হাজিরা সিস্টেম বন্ধের বিষয়ে অধ্যক্ষ জানান, করোনার পর সিস্টেমে কিছু ত্রুটির কারনে বন্ধ আছে। তবে অতিদ্রুত কয়েকদিনের মধ্যেই বায়োমেট্রিক হাজিরা চালু হবে।


উচ্ছ্বসিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা
প্রাণের বিদ্যাপীঠ শতবর্ষ পূর্ণ করায় আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে কলেজের সাবেক বর্তমান শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। শিক্ষার্থীরা শতবর্ষ উপলক্ষ্যে আয়োজিত র‌্যালিতে প্রিয় বিদ্যাপীঠের জন্মদিনের স্লোগানে মুখরিত করে রাখে কলেজ ক্যাম্পাস। নিজের প্রিয় বিদ্যাপীঠের জন্মদিনে অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আবেগঘন লিখা লিখেছেন।

কলেজের শতবর্ষে সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর বিমল কান্তি পাল বলেন, ১৯২২ সালে স্থাপিত হওয়া এই কলেজ আজ শতবর্ষ পার করেছে। বৃহত্তর নোয়াখালীর শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্যবাহী শত বছরের কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে আমি গর্বিত।

তিনি বলেন, শতবর্ষ উদযাপনের প্রস্তুতি ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। আগামী নভেম্বরে জাঁকজমকপূর্ণভাবে শতবর্ষ উদযাপন করা হবে। এসময় তিনি কলেজের সাবেক বর্তমান শিক্ষার্থী ও শুভানুধ্যায়ীদের কলেজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানান।

কলেজের রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নুরুল আজিম ভুঞা বলেন, এইদিনটি সকলের জন্য আনন্দের ও ঐতিহাসিক একটি দিন। ফেনী কলেজ তার কৃতিত্বের সাক্ষর আগেও রেখেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেও এই কলেজ সফল। তিনি বলেন, এই কলেজের শিক্ষকতা করাটাও আমাদের জন্য গর্বের। এসময় তিনি শতবর্ষী ফেনী সরকারি কলেজকে আরও এগিয়ে নিতে সবাইকে কাজ করার আহবান জানান।

শিক্ষক পরিষদ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন বলেন, এদিন ফেনী কলেজের জন্য আনন্দের দিন। শোকের মাস হওয়াতে অনাড়ম্বর পূর্ন ভাবে না করলেও এইদিনটি গৌরবের। এই কলেজে শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ রয়েছে। অনেক ভালো শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন। নভেম্বরে সাবেক বর্তমান শিক্ষার্থীদের নিয়ে শতবর্ষ উদযাপন অনাড়ম্বর পূর্নভাবে করা হবে।

ফেনী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ও জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি তোফায়েল আহমেদ তপু বলেন, এই কলেজ এই অঞ্চলের পছন্দের বিদ্যাপীঠ। আগস্ট মাসে বড় কোন আয়োজন না থাকলেও এইদিনটি আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের ও গর্বের। এই কলেজের শিক্ষার্থী এবং ছাত্র সংসদের ভিপি হিসেবে গর্ববোধ করি।

ফেনী কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি নোমান হাবীব বলেন, শতবর্ষী ফেনী কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পেয়ে আমি গর্বিত। এই সর্বোচ্ছ বিদ্যাপীঠের রাজনীতির দায়িত্বে নেয়া জীবনের সেরা সফলতা। তিনি বলেন, কলেজে সুন্দর পরিবেশ বিরাজমান রয়েছে৷ শিক্ষক শিক্ষার্থী সকলে মিলে কলেজের উন্নয়নের জন্য কাজ করছে।

কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান নাবিলা বলেন, ফেনী কলেজের সময়কাল জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। এই কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবে আমি গর্বিত। শিক্ষা জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কলেজ ক্যাম্পাসেই কাটিয়েছি।

এভাবেই সাবেক বর্তমান শিক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে তাদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। কলেজ জীবনের বিভিন্ন স্মৃতিকথা তুলে ধরেছেন।