বাবা, আমার ছেলের বয়স যখন পাঁচ মাস তখন পাকিস্তানে তার বাবা মারা যায়। আমি ছেলেকে নিয়ে দেশে চলে আসি। আমার আত্নীয় স্বজনরা সবাই মিলে আমাকে ঘরটা করে দেয়। সে ঘরেই আমি গত ১৭ বছর আমার ছেলেটাকে আঁকড়ে ধরে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। আমার ছেলে কখনো এত বড় অপরাধ করতে পারেনা। সে খুন করতে পারেনা। এর পরও আপনারা কি জানি কতগুলো পরীক্ষা করেন, সে গুলু করে যদি দেখেন আমার ছেলে অপরাধ করেছে তাওহলে তাকে শাস্তি দিয়েন। আমার ছেলে যেমন আমার নিকট আদরের তেমনি তাদের মেয়ে তিশাও তাদের নিকট আদরের।

কথাগুলো একটি সরাসরি সম্প্রচারিত অনলাইন পোর্টালের রিপোর্টারের সাথে বলছিলেন ফেনীর কালীদহের মাইজবাড়িয়া গ্রামে নৃশংস ভাবে জবাই করে হত্যা করা ৬ষ্ট শ্রেনীর ছাত্রী তিশার খুনের দায়ে অভিযুক্ত নিশানের মা।

মায়ের চোখে কি নিদারুণ অসহায়ত্ব। কতদিন নিজে না খেয়ে ছেলেকে খাইয়েছেন, অসুস্থ ছেলের মাথার পাশে কত নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। বাবা নেই বলে বাবার অভাব পুরণে সদা ব্যস্ত ছিলেন। অথচ কি নির্মম, কি রুঢ় বাস্তবতা! সেই মা আজ ছেলের অপরাধে সমাজে অনেকটা সমাজ ছাড়া, বেঁচে থেকেও মৃত। একদিকে অপরাধীর মা হিসাবে সমাজের রক্তচক্ষুর আস্ফালনে নিস্তব্ধ, অন্যদিকে একমাত্র বুকের ধন কিশোর অপরাধী হিসাবে আজ দেশের প্রচলিত ফৌজদারী দণ্ডবিধির প্রচলিত সর্বোচ ধারার অপরাধী হিসাবে অভিযুক্ত।

সব হারিয়ে যাকে বেঁচে থাকার অবলম্বন বানিয়েছিলেন, বুকে আঁকড়ে ধরে রাতে ঘুম পাড়িয়ে ছিলেন, সেই বুকের ধনকে হয়ত তার জীবদ্দশায় আর বুকে আঁকড়ে ধরে আদর করার বা পাশে বসিয়ে খাইয়ে দেয়ার সুযোগ পাবেন না এই হতভাগ্য মা। একজন অভিবাবক, একজন সন্তানের পিতা হিসাবে এই দৃশ্য কল্পনা করতেই বুক ধড়ফড় করে উঠে। প্রতিনিয়তই মনে হচ্ছে নিশানদের বখে যাওয়া রুখতে স্ব স্ব অবস্থান থেকে আমরা কি করছি? বিপ্লবী ক্ষুদিরাম যে বয়সে মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রাণ দিয়েছেন সে বয়সে নিশানরা কেন খুনি হয়ে উঠছে?
এই দায় কার?
পল্লী কবি জসীমউদ্দিন তাঁর "তরুণ কিশোর কবিতায়" লিখেছেন
তরুণ কিশোর !
তোমার জীবনে সবে এ ভোরের বেলা।
ভোরের বাতাস, ভোরের কুসুমে জুড়েছে রঙের খেলা।
কবির সাথে এক সুরেই বলতে চাই

ব্যক্তিত্বের উন্মেষ শৈশবে হলেও কিশোর বয়সে ঘটে ব্যক্তিত্বের জাগরণ। এটিই হল বয়ঃসন্ধিকাল। এ সময় কিশোরের শরীরে ও মনে যে আলোড়ন ঘটে তাতে সে ভাংগা গড়ার খেলায় মেতে উঠে। সব কিশোরই জীবনের এ পর্যায়ে যৌন চেতনার উন্মেষে শারিরীক ও মানসিক সমস্যায় ভোগে। এই সময়ে তার জন্য প্রয়োজন নির্মল আনন্দ, সুস্থ বিনোদন ও সৃজনশীল দলীয় কাজে উৎসাহ দান, যথাযথ কাউন্সিলিং।

কিন্ত আমরা কি সেটি করছি? মোটেই না। আমরা খেলার মাঠ দখল করে অট্রালিকা বানাচ্ছি, পার্ক দখল করে ব্যবসার পসর সাজাচ্ছি, আমাদের অতি ব্যস্ততা, অতি আদর, চাওয়া মাত্রই সন্তানের সব ভাষনা পুরনের মানসিকতা বা অভাবের তাড়নায় সন্তানেক সব কিছু থেকে বঞ্চিত করা, এসব কারনেই আজ তারা লক্ষভ্রষ্ট।

যে বয়সে আমরা গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে ঘুরে পাখির ছানা খুজে বেড়িয়েছি, হাডুড়ু, গোল্লাছুট, ফুটবল, ক্রিকেট বা দাঁড়িয়াবান্ধা খেলায় মেতে থাকতাম, ঠিক সে বয়সেই আমরা আমাদের সন্তানদের হাতে তুলে দিচ্ছি দ্রুত গতির ইন্টারনেট যুক্ত মোবাইল, ল্যাপটপ, মোটর সাইকেল।

আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে তারা প্রতিনিয়তই যৌন সুড়সুড়ির পশ্চিমা সংস্কৃতিকে বুকে লালন করে বাস্তবে প্রয়োগ করতে গিয়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারনে বাঁধার সন্মুখীন হয়ে প্রায়শই অপরাধের জন্ম দিচ্ছে। আর এভাবেই মা বাবার বেঁচে থাকার অবলম্বন নিশানরা হারিয়ে যাচ্ছে।

সমাজে আর কোন নিশান যাতে জন্ম না নেয়, তাই এক্ষুনি আমাদের সচেতন হতে হবে। নিজেকে শুধু টাকা কামানোর মেশিন না বানিয়ে সন্তানদের সময় দিতে হবে। সে কোথায় যায়, কি করে, কার সাথে মিশে এবং তার আচরনে কোন অস্বাভাবিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে কিনা সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে রুপান্তরিত করতে হবে। তৈরি করতে হবে বাস্তবমুখী আনন্দ নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার।

তবেই আমরা নিশানদের রক্ষা করতে পারব।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক
ব্যবস্থাপনা বিভাগ
ফেনী সরকারী কলেজ