সন্তানকে বিদেশ পাঠানোর জন্য পাসপোর্টসহ কাগজপত্র প্রস্তুত করে ঘরের আলমারিতে রেখেছিলেন রেহেনা আক্তার। ভিসার জন্য ধার দেনা করে কিছু টাকাও জমিয়েছিলেন। রেহেনা স্বপ্ন দেখেছিলেন সন্তান বিদেশ গিয়ে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করবে। জমি কিনে নতুন করে ঘর করবেন। কিন্তু সর্বনাশা আগুনে পুড়ে তার সব স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। গতকাল রবিবার (২৫ এপ্রিল বিকালে) কান্না সামলে এভাবেই নিজের দুদর্শার কথা বর্ণনা করছিলেন তিনি।

গত শনিবার (২৪ এপ্রিল) বিকেল সাড়ে তিনটায় ধর্মপুরের বটতলা গ্রামের মুন্সি বাড়িতে আগুন লেগে মুহুর্তে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে রেহেনার মত আরও ৮ পরিবারের স্বপ্ন। কারও ঘরে রাখা নগদ টাকা পুড়েছে, কারও জমির দলিল পত্র প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। সব হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটছে কারও, আবার কেউ বা আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিবেশীর বাড়িতে। আট পরিবারের সকলেই নিম্ন আয়ের মানুষ।

মানিক নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, খুরশীদ আলমের ঘর হতে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের কারণে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। তিনি জানান, আগুনের লেলিহান শিখায় এক সঙ্গে আটটি ঘর পুড়ে মাটির সাথে মিশে গেছে। খবর পেয়ে ফেনী ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রায় ১ ঘন্টার প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

ফেনী ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের সিনিয়র স্টেশন অফিসার জাকের হোসেন জানান, ৯৯৯ সহ একাধিক মোবাইলে থেকে ধর্মপুর বটতলা গ্রামে অগ্নিকাণ্ডের সংবাদ পেয়ে ৪ টা ২০ মিনিট নাগাদ ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস পৌঁছে। প্রায় ১ ঘন্টা ২০ মিনিট চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। প্রাথমিকভাবে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটে আগুন লেগেছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। অগ্নিকান্ডে প্রায় ৮ লাখ টাকার মত ক্ষতি হয়েছে।

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত খুরশীদ আলম বলেন, সাড়ে ৩টার সময় ঘরে মোবাইল চার্জ দিতে গেলে শর্ট সার্কিট ঘটে। আগুনের স্ফুলিঙ্গ ঘরের ভেতর থাকা শুকনা পাতার উপর পড়লে তা মুহূর্তে জ্বলে ওঠে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। শোরচিৎকার শুনে সবাই ছুটে এলেও ততক্ষণে আগুন আশেপাশের আরও ৭টি ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। আগুনে ঘরের সকল আসবাবপত্র পুড়ে গেছে। কোন কিছুই রক্ষা করা যায়নি।

খুরশীদ আলমের স্ত্রী বলেন, যখন আগুন লাগে তখন আমি ঘুমে ছিলাম। আগুন আগুন চিৎকার শুনে কোন রকম ঘর থেকে বের হয়ে প্রান বাঁচিয়েছি।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাসরীন সুলতানা জানান, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগদ ৩ হাজার টাকা করে অনুদান ও ২০ টি কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। ঘর নির্মাণ করার জন্য তাদেরকে ২ বান ঢেউটিন দেয়া হবে।

ধর্মপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য নাসির উদ্দীন বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ইফতার সামগ্রী ও খাবার দেয়া হয়েছে। এই মুহুর্তে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো খাবার ও থাকার জন্য ঘর নির্মাণ জরুরী। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যদি ঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে আমরা ঘর তৈরিতে সহযোগিতা করবো।

অনিশ্চিত জীবনের মুখোমুখি

অগ্নিকান্ডে সব হারিয়ে অনিশ্চিত জীবনের মুখোমুখি ৮ পরিবারের প্রায় অর্ধশত নারী-পুরুষ। তাদের প্রায় সকলে নিম্ন আয়ের মানুষ এবং পরস্পরের আত্মীয় স্বজন। আগুনে পুড়ে বর্তমানে কেউ খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছেন, কেউ সহায় সম্বল হারিয়ে একেবারে নি:স্ব হয়েছে গেছেন।

অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত মোঃ মানিক বলেন, অল্প একটু জায়গার মধ্যে আমাদের ৮ পরিবারের ঘর। একটার সাথে একটা লাগোয়া হওয়ায় আগুনের হাত থেকে কোন ঘরই রক্ষা পায়নি। কোন রকম নিজেদের জীবন রক্ষা করেছি। গতকাল থেকে পরিবার নিয়ে আমরা খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছি। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু হারিয়ে স্ত্রী সন্তান নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছি।

খালেদা আক্তার নামে এক গৃহিনী বলেন, স্বামী দিন মজুরের কাজ করেন, কত কষ্ট করে খেয়ে না খেয়ে ঘরে আসবাবপত্র ও জিনিসপত্রগুলো যুগিয়েছি। সর্বনাশা আগুন এক মুহুর্তে তা বিলীন করে দিলো। আমরা এখন কি করে বাঁচবো, কোথায় থাকবো। সন্তানদের নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই ও দুমুঠো খাবারের জন্য সরকার ও বিত্তশালীদের সাহায্য চান খালেদা।

আরিফ নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, আগুনে আমার ঘরে সকল কিছুই পুড়ে গেছে। কোন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। স্ত্রী সন্তান নিয়ে কোথায় থাকব, কি করব বুঝছি না।

এমরান নামে আরেকজন বলেন, রমজানের দিন হওয়ায় আগুন লাগার সময় অনেকেই ঘরের বাইরে ছিলেন, কেউ ঘুমাচ্ছিলেন। তাই নিজেদের রক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই রক্ষা করা যায় নি। সকলের আসবাবপত্রসহ ঘরের সকল জিনিসপত্র পুড়ে ছাই হয়েছে।


মাথা গোঁজার আশ্রয় চান তারা

ধর্মপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বটতলা গ্রামের মুন্সি বাড়িতে অগ্নিকাণ্ডে মাথা গোঁজার শেষ আশ্রয়টুকু হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন ৮ পরিবারের প্রায় অর্ধশত নারী-পুরুষ। মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে বসতঘর পূনঃ নির্মাণে ফেনী জেলা প্রশাসন ও ফেনী ২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী সহযোগিতা চান ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।

ভুক্তভোগী মোঃ মানিক বলেন, আমরা নিন্ম আয়ের মানুষ। বাপ দাদার ভিটায় সামান্য একটু ভূমিতে কোনরকম ঘর করে পরিবার নিয়ে বসবাস করতাম। অগ্নিকাণ্ডে আমাদের শেষ আশ্রয়টুকুও চলে গেলো। আবার ঘর নির্মাণ করার মতো আমাদের সামর্থ্য নেই। ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী ও জেলা প্রশাসন থেকে যদি আমাদের ঘর নির্মাণের জন্য সহযোগিতা করা হয় তাহলে অন্তত স্ত্রী সন্তান নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবো।

নুরুল ইসলাম একজন বলেন, আগুনের হাত থেকে আমার ঘরের কোন কিছুই রক্ষা করা যায়নি। বহুকষ্টে গড়া ঘরটি চোখের সামনেই আগুনের পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। শুধুমাত্র পরনের কাপড় নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছি।

খালেদা আক্তার নামে একজন বলেন, আগুনে সর্বস্ব হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে গতকাল অন্যের ঘরে রাত কাটিয়েছি। আজ রাত কোথায় থাকবো তার কোন নিশ্চয়তা নেই। সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করে দিলে আমরা সন্তানদের নিয়ে একটুকু আশ্রয় পাবো।

রেজিয়া বেগম নামে একজন বলেন, এমনিতেই করোনায় অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটছে এর মধ্যে মাথা গোঁজার ঠাঁইটাও হারালাম। আমাদের সহযোগিতা না করলে এই দূর্যোগ থেকে আমরা ঘুরে দাড়াতে পারবো না।