নুরুল আলম ফেনী জেলা শহরের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। মাসে বেতন পেতেন সাত হাজার টাকা। এ ছাড়া কিছু ছাত্রছাত্রীকে ব্যাচে পাড়াতেন। পাশাপাশি সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত বাসায় গিয়ে করতেন টিউশনি। সব মিলিয়ে মাসে ৩০-৩৫ হাজার টাকা পেতেন। এতেই মোটামুটি সংসারের খরচ মিটে যেত তাঁর। কিন্তু করোনার কারণে গত বছরের মার্চ থেকে তাঁর সবই বন্ধ রয়েছে। এরপর ঋণ ও জমানো টাকায় সংসার চালিয়ে এলেও এক সময় তাও ফুরিয়ে যায়। এখন তার চোখে মুখে ঘোর অন্ধকার, ভবিষ্যত নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে তার।

শুধু নুরুল আলম নয়, এটি জেলার সব বেসকরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের দুরাবস্থার চিত্র। আবার কেউ কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে না পেরে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছেন গ্রামে, আবার কেউ বিবেকের তাড়নায় হাত পাততে না পারায় বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিবার-পরিজন নিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের প্রভাবে এভাবেই দিন কাটছে ফেনীর প্রায় ৫ হাজার বেসরকারি শিক্ষক, কর্মচারীর পরিবারের। দীর্ঘ ১৩ মাস ধরে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় বেতন-ভাতা পাচ্ছে না তারা। বেতন-ভাতা দাবী করলেও এখন পর্যন্ত কোন প্রকার সাহায্য সহযোগিতা পান নি বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা।

জেলা কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, ফেনীতে প্রায় ৪০০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে, নিয়োজিত রয়েছেন ৪ হাজার শিক্ষক ও দুই হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। শিক্ষার্থীদের বেতন থেকেই এসব শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হতো।

শহরের প্রেসিডেন্সি স্কুল এন্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক ওমর ফারুক বলেন, করোনার বেসরকারি স্কুল কলেজের শিক্ষকরা আর্থিকভাবে ব্যাপক সমস্যায় পড়েছে। ফলে শিক্ষকতার মতো এই মহান পেশা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে অনেকে।

শহরের পশ্চিম ডাক্তার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বেসরকারি স্কুল শিক্ষিকা বলেন, করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতে স্কুল বন্ধ হবার পর থেকে বেতন ভাতা পাইনি আমরা। আমার তিন সন্তানের মধ্যে একজন দুধের শিশু। তার জন্য দুধ কিনতে না পেরে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছে সহায়তা চাই। কিন্তু চক্ষুলজ্জার কারণে সেটি আমি নিতে পারিনি। গত ১৩ মাস ধরে খুবই দুর্বিষহ জীবন কাটছে, যা কাউকে বলতে পারছি না।

মাইমুনা আক্তার পলি নামে অপর এক বেসরকারি স্কুল শিক্ষিকা বলেন, গত বছরের করোনার প্রভাব অন্য সবাই তুলনামূলকভাবে কাটিয়ে উঠতে পারলেও বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকরা পারেনি। দীর্ঘ অনেক মাস ধরে বেতন পাচ্ছি না। ভেবেছিলাম এবার খুলবে স্কুল, কিন্তু করোনার প্রকোপ আবার বেড়ে যাওয়াতে লকডাউনের কারণে কখন খুলবে তার নিশ্চয়তা নেই। তিনি বলেন, স্বামী দেশের বাইরে থাকে। সেখানে কোন কাজকর্ম নেই। তাই টাকাও পাঠাতে পারছে না। এক সন্তান নিয়ে পরিবার আমার উপার্জনের টাকায় সংসার চলে যেত, করোনার কারণে স্কুল বন্ধ হওয়াতে আর্থিকভাবে অভাব অনটনের দিন কাটছে আমাদের।

শহরের কয়েকটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকরা বেতন কিছুটা পেলেও গ্রামের দিকের স্কুলগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে। শিক্ষক আরিফুর রহমান বলেন, পড়ালেখা শেষ করে বেকার বসে ছিলাম। জীবিকার তাগিদে গ্রামের একটি প্রাইভেট স্কুলে চাকরি নিই। ভালোই চলছিল দিনকাল। কিন্তু করোনার কারণে সে যে গতবছর টাকা বন্ধ হয়েছে এখনও পাওয়ার নাম নেই।

তিনি বলেন, শিক্ষকদের পেশায় এত ধস নেমেছে যে অন্য সব পেশার মানুষ বেতন পাচ্ছে। শুধুমাত্র বেসরকারি শিক্ষকরা তাদের বেতন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।। অথচ এই বেসরকারি শিক্ষকরাই সরকারি স্কুলের চাপ কমিয়েছে। বেসরকারি শিক্ষকদের কথা বিবেচনা করে দ্রুত স্কুল খোলা সহ বেতনের ব্যবস্থা করে দেয়ার দাবী জানান তিনি।

শিক্ষকরা জানান, শিক্ষক সমাজকে বাচাঁতে হলে প্রণোদনার কোন বিকল্প নেই।

এ ব্যাপারে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা কাজী সলিম উল্লাহ জানান, বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনগুলো নিজস্ব অর্থায়নে চলে। তাদের সরকারি কোন নিবন্ধন নেই। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারি কোন সহায়তা দেয়া হয় না।

একই কথা বলেছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো: নূরুল ইসলাম। তিনি জানান, বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনগুলোর সরকারি নিবন্ধিত নয়। তাই তারা কোন প্রকার সরকারি সহায়তা পান না।


সাহায্য চাইলেও মেলে নি এখনও

শিক্ষকদের সহায়তার জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন জানালেও এখন পর্যন্ত কোন প্রকার সাহায্য মেলে নি বলে জানিয়েছেন জেলা কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়শনের সভাপতি মামুনুর রশিদ। তিনি দৈনিক ফেনীকে জানান, বেসরকারি শিক্ষকদের সহায়তার জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে। অনলাইনে জুম এ্যাপসে এক ভার্চুয়াল বৈঠকে আমরা দুরাবস্থার কথা শিক্ষা অফিসকে জানিয়েছিলাম। কিন্তু এখনো কোন শিক্ষক কোন প্রকার সহায়তা পান নি। এছাড়া বিভিন্ন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানালে তারা ত্রাণ নেবার কথা বলেন। কিন্তু শিক্ষকরা সেটি নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

শিক্ষার্থীদের এসাইনমেন্ট নেবার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে মামুন জানান, করোনার এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় শিক্ষকদের সহায়তার জন্য আমরা এসাইনমেন্ট ব্যবস্থা চালু করেছিলাম। কিন্তু অনেক শিক্ষার্থী এতে সাড়া দেয় নি। যে পরিমাণ এসাইনমেন্ট জমা হয়েছিল, তার এক তৃতীয়াংশের টাকাও আমরা পাই নি। আবার অনেক অভিভাবক বকেয়া বেতন পরিশোধ করে নি। অভিভাবকদের কাছে বেতন চাইলে তারা বলেন, স্কুল বন্ধ আমরা বেতন কেন দেব। এতে জেলার অনেক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে।



ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরাও

করোনাকালে সংকট শুধু শিক্ষকদের নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরাও। করোনায় শিক্ষার্থীদের ক্ষতির কথা উল্লেখ করে প্রেসিডেন্সি স্কুল এন্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক ওমর ফারুক বলেন, শিক্ষকদের যতটুকু ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশী শিক্ষার্থীদের হয়েছে। অনলাইনে শ্রেনী কার্যক্রম চালালেও শিক্ষার্থীরা তাদের প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি বলেন, অনলাইন ক্লাসের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় ছোট ছোট বাচ্চারাও মোবাইলের প্রতি অতিরিক্ত আসক্ত হয়ে পড়ছে যা তার ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক ক্ষতি। এছাড়া অনেক অভিভাবকের কাছে এ্যান্ডড্রয়েড ফোন না থাকায় শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাস করতে পারছে না।

মো: আলমগীর নামে এক অভিভাবক জানান, প্রায় ১৩ মাস ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাচ্চাদের পাঠ্য বইয়ের সাথে কোনপ্রকার যোগাযোগ নেই। বারবার বলেও তাদেরকে পড়ার টেবিলে বসানো যাচ্ছে না। এছাড়া বেশিরভাগ সময় তারা মোবাইলে গেমস খেলে এবং টেলিভিশন দেখে সময় কাটাচ্ছে। তাদের মন মানসিকতারও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে।

শামীমা আক্তার শম্পা নামে আরেক অভিভাবক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ছেলে মেয়েরা লেখাপড়ার স্বাভাবিক নিয়ম থেকে সরে যাচ্ছে। এতে করে তারা লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ঘরবন্দী জীবনে অবসর কাটাতে শিক্ষার্থীরা টিভি, মোবাইল তথা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। যা তাদের বেড়ে ওঠায় নেগেটিভ প্রভাব ফেলবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় সন্তানদের এসব বিষয়ে অভিভাবকরাও তেমন কঠোর কোন ভুমিকা নিতে পারছে না।