শিল্প বিষয়টি মানব সভ্যতা সৃষ্টির সাথে সাথে রূপ লাভ করেছে। যতদিন মানব-সভ্যতার প্রকৃত বিকাশ ঘটেনি ততদিন সে প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার সাথে লড়াই করেছে শুধুমাত্র জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য কিন্তু যেদিন থেকে মানুষ তার জীবন ধারণের সমস্যা কিছুটা দূর করতে পারলো, সেদিন থেকেই সে জীবন এবং জগতের সৌন্দর্য্যতা সম্পর্কে জ্ঞাত হতে থাকলো। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “শিল্প হচ্ছে তাই যা নিছক প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি তাগিদ থেকে মানুষকে চালনা কোরে শিল্প সৃষ্টিতে নিযুক্ত করে”। রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি শিল্প চর্চার ক্ষেত্রে অনেকটাই যুক্তিযুক্ত। বর্তমানে বাংলাদেশে অনেক নারীরা এগিয়ে এসেছে শিল্প চর্চায়। অনলাইন প্লাটফর্মে উদ্যোক্তা হয়ে নিজেদের সাবলম্বী করার পাশাপাশি চর্চা করছে হারিয়ে যাওয়া শিল্পগুলো এবং নিত্যনতুন দিনে গড়ে তুলছে অপার সম্ভাবনা।

অধ্যাপক আব্দুস সালাম তার কবিতায় বলেছেন ‘পাট ছিলো এই বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল, অন্য কিছু ছিলো নাকো ইহার সমতুল’ আর সেই সোনালী আঁশ পাট শিল্প নিয়ে কাজ করছেন ফেনীর মেয়ে নন্দিতা সাহা। উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরামের নারী উদ্যোক্তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেই অনলাইনে গড়ে তুলেছেন নিজের প্লাটফর্ম ‘কনকমুকুর’।

যিনি ইতিমধ্যে পাট দিয়ে গহনা তৈরী করে গোলাপের রঙে রাঙাচ্ছেন নিজেকে এবং তার স্বপ্নের কনকমুকুরকে।
কনকমুকুর গড়ার স্বপ্ন, যাত্রা এবং সার্বিক বিষয় নিয়ে দৈনিক ফেনীকে এর উদ্যোক্তা পাটকন্যা খ্যাত নন্দিতা সাহা। পাঠকদের জন্য নন্দিতা সাহার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মোস্তাফিজ মুরাদ।

দৈনিক ফেনী-কনকমুকুর গড়ার চিন্তা প্রথম কিভাবে মাথায় এসেছিল?
নন্দিতা-আমি কখনো উদ্যোক্তা হব ভাবিনি। লকডাউনের সময় ঘরবন্দি হতাশা গ্রাস করছিল। তখন দেখা পেয়েছিলাম উইমেন এন্ড ই কমার্স ফোরামের। সেখানে হাজারো নারী উদ্যোক্তাদের নিজের জন্য কিছু করতে দেখে সাধ জেগেছিল নিজের জন্য কিছু করার। সেই ভাবনা থেকেই ধীরে ধীরে কনকমুকুরের সৃষ্টি।

দৈনিক ফেনী- আরও অনেক কিছুই তো ছিল কিন্তু পাটজাত পণ্য নিয়ে কাজ করার চিন্তা মাথায় কিভাবে আসল? এটির উদ্দেশ্য কি?
নন্দিতা-প্রথমে কি করবো কি করা যায় ভাবতে ভাবতে মাথায় এলো আমি তো গয়না ভালোবাসি, তাহলে গয়না নিয়েই কাজ করি। প্রথমে সুঁই সুতা নিয়ে গয়না বানাতে বসলেও পরে পাট নিয়ে বসেছিলাম। প্রথম তৈরী গয়না ছিল “পদ্মপ্রণাম”। মূলত দিদির অনুপ্রেরণায় পাট নিয়ে কাজ করা।
এখনকার যুগের মানুষ ইউনিক জিনিস খুব পছন্দ করে এবং আমি নিজেও ব্যাতিক্রম নই। তাই একেবারেই ইউনিক কিছু করতে আমার পাট নিয়ে কাজ করা। খুব কম দেখেছি যারা পাটের গয়না নিয়ে কাজ করেছে বা করছে। তাই আমি আরও দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকার নিয়েছি যে আমি পাটের গয়না নিয়েই কাজ করবো। আমাদের হারিয়ে যাওয়া সোনালী আঁশ পাটকে সোনার সমতুল্য করে পুরো বিশ্বের কাছে তুলে ধরাই কনকমুকুরের মূল লক্ষ্যে এবং উদ্দেশ্য। আমি চাই আমার তৈরী গয়না সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে যাক। পাট কে সবার অহংকার হিসেবে তুলে ধরতে চাই। তাইতো কনকমুকুরের মূল কথা, “পাটজাত দেশী পণ্যই হোক আমাদের অহংকার”।

দৈনিক ফেনী- আপনি কনকমুকুর এর পাটকন্যা হিসেবে ইতোমধ্যে পরিচিতি পেয়েছেন বিষয়টা কেমন উপভোগ করছেন?
নন্দিতা-প্রায় সবার মনেই একটা ইচ্ছা থাকে তাকে অনেক মানুষ চিনবে, জানবে, স্নেহ করবে, পছন্দ করবে। আমার এমন একটা ইচ্ছে সবসময় ছিল। আমার কাজ আমাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছে। এখন কম হলেও ১০০ জন আমায় পাটকন্যা হিসেবে চেনেন, জানেন, পছন্দ করেন। এটা উপভোগ্য হওয়ার মতোই। কারণ স্বপ্ন পূরণ হওয়া সবার জন্য আনন্দের।

দৈনিক ফেনী- প্রতিষ্ঠার পর থেকে মানুষ কনকমুকুরকে কিভাবে গ্রহণ করছে?
নন্দিতা-কনকমুকুরের শুরু ২০২০ সালের ১৬ জুলাই থেকে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইউনিক পন্য হিসেবে ভালোই সারা পাচ্ছি। আর এর সব কিছুই উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরামের জন্য। আমার সব ক্রেতাই সেখানের। এটা অনেক বড় পাওয়া। উই এর জন্যই আমার কাজকে আমি আরও ভালো করে সবার সামনে তুলে ধরতে পারছি। তারা আমার গয়না পছন্দ করছেন এবং নেয়ার ইচ্ছা পোষণ করছেন। সব মিলিয়ে ভগবানের আশির্বাদে ভালোই যাচ্ছে।

দৈনিক ফেনী-কনকমুকুর নিয়ে স্বপ্ন কি আপনার? কনকমুকুর কে ১০ বছর পর কোন অবস্থায় দেখতে চান?
নন্দিতা-১০ বছর পর আমি কনকমুকুর কে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে দেখতে চাই। এখন কার যুগে মানুষ ব্র্যান্ডের জিনিসই বেশী পছন্দ করে এবং ভরসা করেন। সেই ভরসা এবং পছন্দের জায়গাটা পোক্ত করতে চাই। বিশ্বের সব জায়গায় আমার গয়না পৌঁছে দিতে চাই।

দৈনিক ফেনী-কনকমুকুরে কি শুধু গহনা সামগ্রী ? নাকি অন্য কিছু যুক্ত করার ইচ্ছা আছে?
নন্দিতা-এখন শুধু গয়না নিয়েই ভাবছি। তবে অনেকেই আবদার করেন মেয়েদের গয়নার পাশাপাশি ছেলেদের জন্য কিছু কাজ রাখার। এইবার সেই ভাবনা থেকেই বসন্ত কে মাথায় রেখে ব্রোচ ডিজাইন করেছি। সামনে আশা করি ক্রেতারা আরও ভালো কিছু পাবেন। তবে সব কিছুই হবে হাতে তৈরী।

দৈনিক ফেনী-গ্রাহক কেমন গহনা পাচ্ছে কনকমুকুর থেকে?
নন্দিতা-গয়নার মধ্যে সব ধরনেরই আছে। চকার, লং নেকপিস, ইয়ার রিং, আংটি, চুড়ি, পায়েল, খোপার ফুল- মানে একজন নারী নিজেকে সজ্জিত করার জন্য যে গয়না পরেন তার সবই আছে। সামনে বিয়ের গয়না নিয়েও কাজ করার ইচ্ছে আছে।

দৈনিক ফেনী-পাটজাত পণ্য ছাড়াও অনেকরকমের গহনা বর্তমান বাজারে বিদ্যমান বা অন্যান্য উদ্যোক্তারা তৈরী করছে ভিন্ন কিছু। কনকমুকুরে কি অন্য কোন সামগ্রী যুক্ত হবে নাকি পাট নিয়েই শুধু চিন্তা ভাবনা করছেন?
নন্দিতা-গয়না যেমনই হোক পাটের ছোঁয়া থাকবেই। যেমন আমি বিভিন্ন ধরনের মেটাল থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক বীজ, সামুদ্রিক ঝিনুক নিয়েও কাজ করেছি কিন্তু সব কিছুতেই পাট ছিলো। পাটের বাইরে কিছু ভাবছি না।

দৈনিক ফেনী- জীবনে স্বপ্ন পূরনের দ্বারপ্রান্তে এগিয়ে যাচ্ছেন দিনদিন। জীবন এর এই পাওয়াটা কেমন উপভোগ করছেন?
নন্দিতা-স্বপ্ন পূরণ সবসময়ই আনন্দের। আমার দেখা স্বপ্নগুলো কখনো পূরণ হবে কি হবেনা সেটা না জেনেই স্বপ্ন বুনেছিলাম। এখন ধীরে ধীরে সেগুলো প্রাণ পাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার নতুন জন্ম হচ্ছে। আমি প্রাণ পাচ্ছি।

দৈনিক ফেনী-প্রথমে কত টাকা দিয়ে শুরু করেছিলেন বর্তমানে আনুমানিক কেমন ইনকাম পাচ্ছেন? অন্যরা হইতো অনুপ্রাণিত হবেন।
নন্দিতা-প্রথম গয়না তৈরী করেছিলাম সম্পূর্ণ ঘরে থাকা জিনিস দিয়ে। তবে প্রথম বিনিয়োগ ছিল ৩৪৫ টাকা। ২০২০ সালের ২৩ আগষ্ট আমি প্রথম অর্ডার পেয়েছিলাম। কাজ শুরুর অনেকটা পরে। তারপর থেকে যা বিক্রি হচ্ছে ভালোই। তবে ২০২১ এ ঠাকুরের আশির্বাদে সেটা বাড়ছে।

দৈনিক ফেনী-সফলতার গল্প শুনলাম আপনার। এবার একটু জানতে চাই কনকমুকুর এর যখন গড়ার ইচ্ছা পোষন করেন কোন প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছেন কিনা? হলেও কিভাবে তা মোকাবেলা করেছেন?
নন্দিতা-কনকমুকুর যখন যাত্রা শুরু তখন করোনার প্রভাব খুব বেশী ছিল। তখন আমার প্রথম অর্ডার এসেছিল ঢাকা থেকে। কিন্তু করোনাকালীন সময়ে তখন ফেনী থেকে ঢাকায় হোম ডেলীভারী দিয়ে গয়নাটা পাঠাতে পারি নি। যদিও গ্রাহক পরে নিতে পেরেছিলেন। এখনো দেখা যায় অনলাইন ব্যসবসার ক্ষেত্রে কুরিয়ার নিয়ে সমস্যাটা খুব বেশী। তখন ক্রেতাকে বুঝিয়ে সফটলি হ্যান্ডেল করতে হয়।

দৈনিক ফেনী- এছাড়া অন্য কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন আজ পর্যন্ত? কনকমুকুর গড়ার ক্ষেত্রে কোন হেয় প্রতিপন্নের শিকার হয়েছেন?
নন্দিতা-এমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি যে তা কিন্তু নয়। আসলে আমি অন্য মানুষের কথা কানে নিই নি। আমাদের জাতীয় খেলা হা-ডু-ডু কেনো জানেন? কারণ আমরা কেউ ভালো কিছু করতে নিলেই তাকে টেনে পেছনে নিয়ে আসতে চাই। এমন মানুষ জীবনে থাকবেই। অনেকেই আছেন যারা এখনো বিভিন্ন কথা বলেন। কিংবা অনেকে ক্রেতার মুখোশ পড়ে হ্যারাস করেন। আমি সব কিছুকেই স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছি। কারণ একজন উদ্যোক্তাকে কখনোই উত্তেজিত হলে চলে না। ঠান্ডা মাথায় সব সমস্যার সমাধান করতে হয়

দৈনিক ফেনী- উদ্যোক্তার পাশাপাশি আপনি একজন সঙ্গীত শিল্পী। গানের চর্চা কেমন চলছে? আর গান নিয়ে ভবিষ্যৎ স্বপ্ন কি?
নন্দিতা-গানের চর্চা ভালোই চলছে। আমার ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিলো আমি একজন রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী হব। এই স্বপ্নকে পূরণ করার লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছি সামনের দিকে।

দৈনিক ফেনী-বিভিন্ন অনলাইন আড্ডায় গান করেন এবং নিয়মিত অনলাইন আলোচনায় অংশগ্রহণ করছেন। এই পরিচিতি কি কনকমুকুর এর মাধ্যমেই পেয়েছেন বলে মনে করছেন?
নন্দিতা-গানের লাইভ অনুষ্ঠান গুলোর শুরু লকডাউনে। টুকটাক গান করে ফেইসবুকে আপলোড দিতাম। তখন থেকেই শুরু। এখন গানের বাইরে ও কিছু আলোচনায় অংশ নিচ্ছি সেগুলো কনকমুকুরের কাজের জন্যই। আসলে আমার কাছে মনে হয় আমার গানের জন্য কাজ, কাজের জন্য গান দুটোই ভালো দিকে প্রভাবিত হচ্ছে।

দৈনিক ফেনী- কনকমুকুর বলেন বা গান এসব ক্ষেত্রে পরিবার থেকে কেমন সহযোগিতা পাচ্ছেন?
নন্দিতা-আমার কাজে এবং গানে পরিবারের সবার সহযোগিতা পাচ্ছি। যেখানে অনেক নারী তাদের কাজে পরিবারের সহযোগিতার অভাবে পিছিয়ে যায় সেখানে আমার পরিবার সবসময় আমার সাথে থাকে। আমি আমার পরিবারের সবার প্রতিই বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।

দৈনিক ফেনী-উদ্যোক্তা হিসেবে বছর পার করতে যাচ্ছেন, নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কি থাকবে?
নন্দিতা-আমার এই সল্প উদ্যোক্তা জীবন থেকে নেওয়া ধারণা থেকেই নতুন উদ্যোক্তাদের বলতে চাই, ইউনিক হোন, ঝুঁকি নিতে ভয় পাবেন না। পরিশ্রমী হতে হবে। কথায় কাজে মিল রাখুন। ক্রেতার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখুন। নিজের পন্য সম্পর্কে জানুন এবং অন্যকে জানান। সব থেকে বড় কথা হতাশ হওয়া যাবে না। সত্য মনের অধিকারী হতে হবে। শেখার কোনো শেষ নেই। তাই রোজ নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করুন।

দৈনিক ফেনী- সর্বশেষ প্রশ্ন, আপনার কনমুকুর এর নামটা কিভাবে প্রথম ঠিক করেছেন? এই নাম কিভাবে মাথায় আসল?
নন্দিতা-কনকমুকুর নামটি দিদির দেয়া। ইউনিক কাজের জন্য ইউনিক নাম থাকবে এটাই আমার ইচ্ছে ছিল। আমি রবীন্দ্র প্রেমী হওয়ায় সেই নাম খোঁজা শুরু করি সঞ্চয়িতায়। সেখানে রবীন্দ্রনাথের লেখা নষ্টনীড় কবিতার একটি অংশ ছিল এমন,
“গোধূলিবেলায় তখনো জ্বলে নি দীপ,
পরিতেছিলাম কপালে সোনার টিপ--
কনকমুকুর হাতে লয়ে বাতায়নে
বাঁধিতেছিলাম কবরী আপনমনে”
এই কবিতা থেকেই দিদি কনকমুকুর নামটি পছন্দ করে দেয় যার অর্থ স্বর্ণের আয়না। গয়নার সাথে আয়নার এবং নারীর উভয়েরই একটি নিবীড় সম্পর্কে রয়েছে তাই কনকমুকুর নাম টাকেই ঠিক করেছি।

গোলাপের রঙে তার স্বপ্নের কনকমুকুরকে রাঙাচ্ছেন পাটকন্যা খ্যাত এই নারী উদ্যোক্তা। নন্দিতা সাহা ৯ ফেব্রুয়ারী ২০০০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ফেনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৬ সালে এসএসসি এবং ফেনী সরকারি কলেজ থেকে ২০১৮ সালে এইএসসি সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগে ২য় বর্ষে পড়াশোনা করছেন। আজ নন্দিতা সাহার জন্মদিন।