মহাকালের আর্বতে বিলীন হয়ে গেল আরও একটি বছর। বিদায় নিলেও ২০২০ সালটা নানা অঘটনের বছর হিসেবে ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে রবে। করোনা আতঙ্কে বিধ্বস্ত মাদনুষ এই বছরে হারিয়েছেন অনেক কিছু। অপ্রাপ্তির ভাঁড়ার হয়তো উপচে পড়ছে বিশ সালে। বছর জুড়ে লকডাউন, সামাজিক দুরুত্ব, হাতধোয়া, মাস্ক পরা, শ্বাসকষ্ট, নেগেটিভ আর পজিটিভ নিয়ে তটস্থ ছিল সাধারণ মানুষ। আর বিষাদময় মৃত্যুর ঘটনাগুলো ছাপ রেখে গেছে এখানে-ওখানে। আবার নৃশংস হত্যা, ধর্ষণ, বন্যা, আত্মহত্যাসহ নানা ঘটনায় ২০২০ সাল জুড়ে জেলা শহর ফেনী ছিল কখনো আলোচিত, কখনো আন্দোলিত, কখনো বিক্ষুব্ধ, কখনো শোকে ম্লান। এক পলকে বছর জুড়ে সেইসব ঘটনাবহুল দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করতে দৈনিক ফেনীর এই ধারাবাহিক আয়োজনের প্রথম পর্ব:

করোনা মহামারীর কবলে ফেনী
গত বছরের ১৬ এপ্রিল জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলায় প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করার কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য বিভাগ। সেই থেকে গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফেনীতে করোনা শনাক্তকৃত ব্যক্তির সংখ্যা দাঁিড়য়েছিল ২ হাজার ২২৭ জনে। আর আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হয়েছিলেন ১ হাজার ৯শ ৯জন, মৃত্যু হয়েছিল ৪৪ জনের। করোনার কবল হতে বাদ যায় নি কেউ। আক্রান্ত হয়েছেন জনপ্রতিনিধি, সরকার কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, চাকুরজীবী, শিশু, যুব, বৃদ্ধসহ সব বয়সী মানুষ। তাদের মধ্যে কেউ মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসে জীবনের মূল্যবোধ পাল্টে নিয়েছেন, আবার কেউ অন্য ভুবনে পাড়ি জমিয়েছেন। আনন্দ, উৎকণ্ঠা, ভীতি আর ঘরবন্দি জীবন, এসব নিয়েই কেটেছে ২০২০ কেটেছে ফেনীর মানুষের। লকডাউন, সামাজিক দুরুত্ব, মাস্ক পরা, নেগেটিভ. পজেটিভ, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন ইত্যাদি শব্দগুলো ঘুরে ফিরেই বারবার উচ্চারিত হয়েছে মানুষের মুখে।

শোকেই কেটেছে বছরের বেশিরভাগ
করোনা মহামারি কত কিছু যে তছনছ করে দিয়েছে তা বলা বাহুল্য, বাবার কাঁধে দিয়েছে ছেলের লাশ, মাকে পরিয়েছে সাদা শাড়ি, বোনকে করেছে বিধবা, ভাইকে করেছে ভ্রাতৃহারা। মৃত্যুর সারিতে যুক্ত হয়েছে কত চেনামুখ, ফেনী হারিয়েছে তার কীর্তিমান সন্তানদের। এক শোকের রেশ কাটতে না কাটতে আরেক শোকের মাতম উঠেছে জেলা জুড়ে। গত বছর ফেনী হারিয়েছে প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ, সংগঠক, দেশবরেণ্য চিকিৎসক, গণমাধ্যমকর্মী, সমাজসেবক, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। গত বছর ফেনী হারিয়েছে ক্লিন ইমেজ খ্যাত সর্বজনবিদিত বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আজিজ আহাম্মদ চৌধুরীকে, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট আক্রামুজ্জমানকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলের চেয়ারম্যান ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীকে, দেশবরেণ্য চিকিৎসক প্রফেসর এসএএম গোলাম কিবরিয়াকে, সিভিল সার্জন ডাঃ সাজ্জাদ হোসেনকে, গেদু চাচা খ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট খোন্দকার মোজাম্মেল হককে, প্রবীন সাংবাদিক নুরুল করিম মজুমদারকে, প্রবীণ আইনজীবী মৌলভী আবুল খায়েরকে, ইত্যাদি খ্যাত জনপ্রিয় অভিনেতা মহিউদ্দিন বাহারকে। গত বছরের মে মাসের ২৪ তারিখে ঘন্টার ব্যবধানে মা দেল আফরোজ বেগম ও বড় ভাই জসিম উদ্দিন হাজারীকে হারিয়েছেন ফেনী-২ আসনের সাংসদ নিজাম উদ্দিন হাজারী। বছরের শোকাতুর ঘটনার মধ্যে এটি ছিল অন্যতম একটি। গত বছরের ২৬ জুন মারা যান একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও দাগনভূঞা উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শরীয়ত উল্লাহ বাঙালি। ২৬ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সাবেক সদস্য, সাবেক আমলা ফেনী ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাছিমের পিতা প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা সালেহ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে। এছাড়া ফেনী হারিয়েছে অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। এছাড়া ভাইয়ের মৃত্যুর ৩৯ দিনের মাথায় মারা যান বৃহত্তর ময়মনসিংহবাসীর ‘রতন স্যার’ কিংবা ‘রতন দা’ হিসেবে পরিচিত ফেনী জেলা পরিষদের প্রয়াত চেয়ারম্যান ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় রাজনীতিবদ আজিজ আহাম্মদ চৌধুরীর ছোট ভাই আমির আহমেদ চৌধুরী। করোনায় প্রায় সব শ্রেণি–পেশার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যুদ্ধের বছর ছাড়া দেশের এত গুণী মানুষ আর কখনো মারা যায়নি। মৃত্যুর তালিকা প্রতিনিয়ত যুক্ত হয়েছে কত নাম, তার হিসেব রাখা সম্ভব হয় নি।

মানবতার পুর্নজন্ম
পুরোনো বছরের আবেগ অনুভূতির মিশেলে মানবিকতা স্থান করে নিয়েছে আতঙ্কিত দিনগুলোর মধ্যেও। কেউ কেউ মানবিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অস্পৃশ্যতাকেও পাশ কাটিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন মানবকল্যাণে। সে হিসেবে বছরটি আমাদের মানবকল্যাণে নবজন্ম লাভে উৎসাহ জুগিয়েছে বলা চলে। লকডাউনের ঘরবন্দী দিনগুলোতে অসহায় মানুষের সাহায্যের হাত বাড়াতে এগিয়ে এসেছে ব্যক্তি, সংগঠন, প্রশাসন, রাজনীতিবিদসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। মানুষ মানুষের জন্য- এ কথা আবার প্রমাণিত করেছেন তারা। ফেনী-২ আসনের সাংসদ একই সহায়তা করেছেন ১ লাখ ২০ হাজার মানুষকে। তার সহায়তা পৌঁছে গেছে জেলার প্রতিটি কোণে কোণে। তার সহায়তা হতে বাদ পড়েনি ইমাম মুয়াজ্জিন হতে শুরু করে মাদ্রাসা এতিম শিক্ষার্থীসহ নিম্ন আয়ের মানুষেরা। এছাড়া ভাসমান মানুষের জন্য প্রতিদিন রান্না করা খাবার ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি। লকডাউনের পুরোটা সময় পরশুরামে থেকে মানবতার কল্যাণে নিরলস কাজ করে গেছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী। পরশুরাম যুবলীগের সভাপতি ইয়াছিন শরীফ মজুমদারও করোনাকালীন সময়ে অসহায় মানুষদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। করোনা মৃত ব্যক্তির লাশ দাফন করতে গিয়ে নিজেও করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবু হাল ছাড়েন নি তিনি।
ফেনীতে করোনাকালীন সময়ে প্রায় ৫ শতাধিক স্বেচ্ছাকর্মী নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ছিলেন। দুঃসময়ে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে তার কাজ করেছেন সকল ভয় ভীতি উপেক্ষা করে। ঘরেবন্দী থাকলেও সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা মহামারীর দুর্দিনে অসহায় মানুষরা নিশ্চিতে থেকেছে।

বছরের আসল হিরোরা
সারা দুনিয়া তোলপাড় করে দিয়েছে করোনা সংক্রমণ। তারই মধ্যে ময়দানে নেমে লড়াই চালিয়ে গেছেন ফেনীর সরকারি হাসপাতালের চিকিৎস, স্বাস্থ্যকর্মীরা। সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে মাঠে ছিলে প্রশাসনের কর্মকর্তারা, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা, গণমাধ্যকর্মীরা। করোনার বিরুদ্ধে একেবারে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করছেন তারা। তাদের প্রত্যেকের কাছেই চ্যালেঞ্জটা ছিল কঠিন। নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে, মানুষের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেছেন তারা। বছর জুড়ে তারাই ফেনীর মানুষকে আশা, ভরসা, সাহস ও শক্তি যুগিয়েছেন।