প্রতি বছরের মতো শীত শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সোনাগাজীর বিভিন্ন বিল-অঞ্চলে ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে শুরু করেছে অতিথি পাখিরা। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠছে এ অঞ্চলের বিল ও তার আশপাশের এলাকাগুলো। এ সুযোগে সৌখিন ও পেশাদার পাখি শিকারিরা বন্দুক, বিষটোপ, জাল ও বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে এসব পাখি নিধন শুরু করছে। পাখি শিকার করা আইনত নিষিদ্ধ হলেও এ বিষয়ে প্রশাসন কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় পর্যটক, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় লোকজন ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

এলাকাবাসীরা জানান, মুহুরী লেক ও মুহুরী রেগুলেটর সংলগ্ন কলমীর চরে প্রতি বছরের মতো এবারও কয়েক প্রজাতির হাজার অতিথি পাখির আগমন ঘটেছে। শীত এলেই সোনাগাজীর বিভিন্ন অঞ্চলে পাখি শিকারীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। তবে উল্লিখিত দুই এলাকায় পাখি শিকারের হার অন্য অঞ্চলের তুলনায় ব্যাপক।

জানা গেছে, সোনাগাজীর বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন এ কাজে জড়িত রয়েছে। এদের মধ্যে অনেক প্রভাবশালীও রয়েছেন। মূলত তাদের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পান না স্থানীয়রা। শিকারিরা এসব পাখি শিকার করে সোনাগাজী উপজেলা শহর, চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা ও ফেনী জেলার বিভিন্ন স্থানে চড়া দামে বিক্রি করছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। প্রজাতি ভেদে এসব পাখি বাজারে ৫শ হতে ৬শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়।

বাংলাদেশের বিশিষ্ট পাখি বিশারদ শাজাহান সরদারের মতে, মুহুরী লেকে প্রায় ১৬ প্রজাতির সাইবেরিয়ান অতিথি (পারিজেয়) পাখি আসে। এদের বেশির ভাগই হাঁস প্রজাতির পাখি। অতিথি পাখির মধ্যে বালিহাঁস, চখাচখি, বাটুল, শামখুল, পানকৌড়ি, শামুকভাঙ্গা, সরাল, লেহেঞ্জা, গিরিয়া হাঁস, টিকি হাঁস, খুনতে হাঁস, গাংচিল, বক প্রভৃতি।

পরিবেশবিদ ড. মেহেদী হাসান জানান, অতিথি পাখি আমাদের দেশের অনেক বড় একটি সম্পদ। এসব পাখি নিধনের কারণে একদিকে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে ফসলি জমিতে ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ বাড়ছে। পাখিরা শুধু প্রকৃতির শোভাবর্ধন করে না, ভারসাম্যও রক্ষা করে।

মুহুরী প্রকল্প এলাকায় বেড়াতে আসা মীরসরাই উপজেলার পর্যটক মতিউর রহমান বলেন, কিছুদিন আগে পরিবার পরিজন নিয়ে বেড়াতে এসে দেখলাম কিছু যুবক এয়ারগান দিয়ে পাখি শিকার করছে।

ফেনী বড় বাজারের গোপাল পট্টির সামনে এক জোড়া অতিথি পাখি নিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় ছিলেন আবদুল মোমিন নামে সোনাগাজীর এক মৎসজীবী। প্রতিটির দাম হাঁকছিলেন ৬শ টাকা করে। মূলত পেশায় একজন মাছ শিকারী হলেও শীতকালে মাছ কমে যাওয়ায় পাখি শিকার করেন।

কলিম উল্লাহ নামে এক ক্রেতার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে, দেখে লোভ লাগে তাই কিনেছি। অতিথি পাখি কেনাবেচা আইনে অপরাধ জানেন কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এ সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই।

বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ মাকসুদ আলম জানান, অতিথি পাখি নিধন রোধে আমাদের একটি দল উপকূলীয় এলাকায় টহল দিচ্ছে। অভিযোগের সত্যতা পেলেই আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। যে বা যারাই অতিথি পাখি শিকার করুক না কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রয়োজনে মামলাও করা হবে।

উল্লেখ্য, বেআইনিভাবে পাখি শিকার দণ্ডনীয় ফৌজদারি অপরাধ। ১৯৭৪ সালে বন্য প্রাণি রক্ষা আইন ও ২০১২ সালে বন্য প্রাণি সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে বলা হয়েছে, পাখি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছর জেল, এক লাখ টাকা দণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত। একই অপরাধ ফের করলে শাস্তি ও জরিমানা দ্বিগুণের বিধানও রয়েছে।

সোনাগাজীর আমিরাবাদ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম জহির জানান, বহিরাগত কিছু মানুষ অতিথি পাখি শিকার করছে বলে আমি শুনেছি। তবে এর প্রতিকারে স্থানীয় জনগণসহ আমরা কাজ করছি এবং শিকার বন্ধে কঠোর ভূমিকা নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

সোনাগাজী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ সাজেদুল ইসলাম বলেন, কারো বিরুদ্ধে পাখি শিকারের খবর পেলে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি মুহুরী লেক এলাকায় পুলিশি টহল জোরদারের ব্যবস্থা করা হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অজিত দেব দৈনিক ফেনীকে বলেন, অতিথি পাখি শিকার দণ্ডনীয় অপরাধ। অতিথি পাখি শিকার রোধে শীঘ্রই কলমীর চর ও মুহুরী লেকে এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হবে। এছাড়া পাখি শিকারে নিরুৎসাহিত করতে মুহুরী লেক এলাকায় ব্যাপক প্রচারণা চালানো হবে বলে জানান ইউএনও।