করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক অ্যাসাইনমেন্টের (কাজ) ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করার নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণলায়। অ্যাসাইনমেন্ট জমা নেওয়া, মূল্যায়নের ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও ফেনীর চিত্র ঠিক উল্টো। এ নিয়ে দৈনিক ফেনী’র অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে পুরো জেলা জুড়ে বিরাজ করছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। কোন কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অ্যাসাইনমেন্টের জন্য নেয়া হচ্ছে টাকা, কোন প্রতিষ্ঠানে পূর্বের বকেয়া পরিশোধ ছাড়া জমা নেয়া হচ্ছে না, আবার কোন প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত উপকরণ ছাড়া শিক্ষার্থীরা অ্যাসাইনমেন্ট করতে পারছে না।

তবে এ নিয়ে হয়রানি বন্ধ করার পক্ষে মত দিয়েছেন ফেনীর শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। শিক্ষা কর্মকর্তা, স্কুল প্রধান শিক্ষকরা অ্যাসানইনমেন্ট’র ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। এ নিয়ে রবিবার (৮ নভেম্বর) জেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভায় বিষয়টি উত্থাপন করেন জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কাজী সলিম উল্ল্যাহ। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসনকে অনুরোধ জানান তিনি।

জেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সন্তানের অ্যাসাইনমেন্ট প্রক্রিয়া নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন মানতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাদের।

সদর উপজেলার শাহীন একাডেমী স্কুলের ৭ম শ্রেণি পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর অভিবাবক বলেন, করোনাকালে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকলেও এখন পুরো সময়ের বেতন জমা দেওয়া ছাড়া অ্যাসাইনমেন্ট জমা নিচ্ছেনা। এছাড়াও অ্যাসাইনমেন্ট প্রস্তুতকরণ নিয়ে শুরু হয়েছে বিভিন্ন জটিলতা। কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অ্যাসাইনমেন্ট তৈরির জন্য আলাদা কাগজ ( এ৪ সাইজ) এবং ফি নির্ধারণ করে দিচ্ছে বলে জানান অভিভাবকরা। তারা জানান, বাজারে অ্যাসাইনমেন্টের জন্য বিভিন্ন শীট পাওয়া যাচ্ছে। সেটিতে অ্যাসাইনমেন্ট করলে সুন্দর দেখায়, তাই আমরা কিনছি।

ফেনী সিটি গার্লস স্কুলের ফি আদায় সংক্রান্ত রশিদে দেখা যায় অ্যাসাইনমেন্ট বাবদ ৩শ টাকা ও বকেয়া বেতন আদায় করা হচ্ছে। আলাদা ফি আদায়ের কথা স্বীকার করে অধ্যক্ষ এম মামুনুর রশিদ বলেন, আমরা অ্যাসাইনমেন্টের জন্য স্কুল থেকে কাগজ, প্রশ্ন প্রদান করছি। যা অনেকে করছে না। এছাড়া প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা অ্যাসাইনমেন্ট নেয়া হচ্ছে। সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে অ্যাসাইনমেন্ট নেবার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারি নির্দেশনা দেবার আগেই আমরা তা নেয়া শুরু করেছিলাম।

ছাগলনাইয়া উপজেলার নিজকঞ্জুরা স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মুস্তাফিজ বলেন, আমার বোনের অ্যাসাইনমেন্ট তৈরির জন্য স্কুলের নির্দেশনা মতে ৬০ টাকা দিয়ে ২০ পাতা (এ৪ সাইজ) কাগজ নিয়েছি। কিন্তু পুরো বছরের ২ হাজার ৪শ টাকা বেতন দিতে না পারায় স্কুলের শিক্ষকরা অ্যাসাইনমেন্ট জমা নেয়নি।

পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর তৌহিদ একাডেমির ৭ম শ্রেণি পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর অভিবাবক বলেন, স্কুলে পুরো বছরের বেতন জমা না দিলে অ্যাসাইনমেন্ট এবং পরবর্তী শ্রেণিতে উন্নিত করবে না বলে জানিয়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ।

নাম প্রকাশ না করে শহরের ট্রাংক রোডস্থ এক ফটোকপি সেন্টারের মালিক জানান, গত কয়দিন ধরে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থী এবং অভিবাবকরা অ্যাসাইনমেন্ট তৈরির জন্য ‘এ ফোর’ সাইজের ছাপানো কভার কাগজ নিয়ে যাচ্ছে। এগুলো ৫০০ কপির একটি বক্স আমরা ১৮৫ টাকায় ক্রয় করলেও চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন অনেক দোকানি দাম বাড়িয়ে দ্বিগুণ বা তিনগুণ পর্যন্ত লাভে বিক্রি করছে।

অ্যাসাইনমেন্ট প্রক্রিয়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের করণীয় উল্লেখ করে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা কাজি সলিম উল্ল্যাহ বলেন, শিক্ষার্থীকে প্রতি সপ্তাহে ৩টি করে ৬ সপ্তাহে মোট ১৮টি অ্যাসাইনমেন্ট দিতে হবে। নির্ধারিত বিষয়ের প্রস্তাবিত অ্যাসাইনমেন্ট জমা নেওয়া, মূল্যায়ন, পরীক্ষকের মন্তব্যসহ শিক্ষার্থীকে দেখানো এবং পরে প্রতিষ্ঠানে সেটি সংরক্ষণ করার কাজ ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে হবে। এই কার্যক্রমে প্রতিটি শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

অ্যাসাইনমেন্ট প্রস্তুত ও জমাদানের নিয়মাবলী উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাদা কাগজে লিখে অ্যাসাইনমেন্ট (কাজ) জমা দেবে। অ্যাসাইনমেন্টের আওতায় ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন, সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন, সৃজনশীল প্রশ্ন, প্রতিবেদন প্রণয়ন ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত আছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক অ্যাসাইনমেন্ট বাবদ ফি আদায় এবং আলাদা পেপার নির্ধারণ সম্পর্কে কাজি সলিম উল্ল্যাহ দৈনিক ফেনীকে বলেন, অ্যাসাইনমেন্টের জন্য কোন প্রতিষ্ঠান আলাদা করে ফি নিতে পারবে না। এটি বাজারের যেকোন ধরণের সাদা কাগজে প্রস্তুত করে জমা দিলেই হবে।

প্রতিষ্ঠানের বেতন আদায় করার প্রশ্নোত্তরে প্রতিবেদককে তিনি বলেন, আগামী ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেতন আদায় সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারির কথা রয়েছে। এ ব্যপারে নির্দেশনা আসলে আমরা তদন্ত করে অতিরিক্ত ফি বা বেতন আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেব।

ফেনী সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুব্রত নাথ বলেন, অ্যাসাইনমেন্টের জন্য শিক্ষার্থীদের আলাদা কোন কাগজের প্রয়োজন নেই। এ বিষয়ে সবাইকে অবগত করা হয়েছে। আমরা বিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে অ্যাসাইনমেন্ট সংক্রান্ত সব তথ্য দিয়েছি। তারপরও কোন শিক্ষার্থীর সমস্যা হলে স্কুলে এসে বুঝে নিতে পারবে।

অ্যাসাইনমেন্ট সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহে সরেজমিনে গিয়ে লক্ষ্য করা যায়, শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া গ্রামের অনেক প্রতিষ্ঠান এখনও এ বিষয়ে অবগত নন। এছাড়া চলতি সপ্তাহে ২য় অ্যাসাইনমেন্ট প্রদানের কথা থাকলেও অনেক প্রতিষ্ঠানে প্রথমটিও প্রদান করতে পারেনি।