শীতল পাটি, পাটি (বটনি) আর চাটাই বুনে নিজেদের সাবলম্বী করছেন ফেনীর এক হাজারের অধিক নারী। হাতে বোনা পাটির বাজারজাতকরণে সদর উপজেলার লেমুয়া, লস্করহাট এবং সোনাগাজী উপজেলার বক্তারমুন্সীতে গড়ে উঠেছে বিশাল বাজার। আড়তদারদের মাধ্যমে পাটি ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। পাটি আড়তদার নজরুল ইসলাম শাহীন জানান, উত্তরবঙ্গের নওগাঁ, নাটোর, বগুড়া, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন জেলায় ফেনীর পাটির দারুণ কদর রয়েছে।

আড়তদারদের তথ্যমতে বছরে প্রায় ১৫ কোটি টাকার পাটি বিক্রয় করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। পাটি বোনায় কাঁচামালের ব্যয় নির্বাহে এদের অধিকাংশের অর্থের যোগান দিয়েছে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্প। কিছু নারী স্ব-উদ্যোগে পাটি তৈরী করছেন বংশ পরম্পরায়।

আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের ফিল্ড সুপার ভাইজার দিলরুবা আক্তার বলেন, ফেনীর লস্করহাট, মোটবী, কালীদহ, ছনুয়া এবং সোনাগাজীর কিছু এলাকায় নারীরা পাটির কাজ পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। তিনি জানান, ছনুয়া ও লেমুয়া ইউনিয়নে প্রকল্পের ৩৯টি সমিতির আওতায় প্রায় ১ হাজার ২৩৫ জন নারী সদস্য রয়েছে। যাদের অর্ধেক পাটি তৈরী করে পরিবারে বাড়তি আয় করে।

প্রকল্পের সদর উপজেলা সমন্বয়ক রিপন দেবনাথ জানান, উল্লেখিত দুই ইউনিয়নে ৩৯টি সমিতিতে ৩ কোটি ৪৯ লাখ ৩৫হাজার টাকা ঋণ প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে পাটি বুনছেন এমন নারী সদস্যদের সোয়া এক কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে।

দিলরুবা আক্তার বলেন, পাটি তৈরী করছেন এমন নারীরা ঋণ পরিশোধে নিয়মিত রয়েছেন।

সোনাগাজী উপজেলা সমন্বয়ক তৌহিদুল ইসলাম জানান, সোনাগাজীতে প্রকল্পের আওতায় ৩ হাজার ৮২৫জন নারী সদস্য রয়েছেন। এদের মধ্যে ২৭৫জন সদস্য পাটি তৈরী করেন। এর মধ্যে ১৭৬জন সদস্য ৬২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেছেন।

ছনুয়া ইউনিয়নের দমদমায় বিবি ফাতেমা প্রায় পঁচিশ বছর ধরে পাটি বুনছেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন আকারের সাধারণ পাটি, চাটাই এবং শীতল পাটির ব্যাপক চাহিদা বাজারে রয়েছে।

বিবি ফাতেমা জানান, একটি শীতল পাটি ১ হাজার ২০০ টাকা হতে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রয় হয়। এতে লাভের হার প্রায় ৩শ শতাংশ। তিনি বলেন, আড়াই হাত ও সাড়ে তিন হাত আকারের একটি ডিজাইন করা সাধারন পাটি তৈরীত ১শ হতে ১২০ টাকা খরচ পড়ে যা বাজারে ৪শ হতে সাড়ে ৪শ টাকা বিক্রয় করা যায়। তিনি আরও জানান, প্রতি মাসে ছোট বড় মিলে ৭-৮টি পাটি একা বানানো সম্ভব।

পাটি তৈরীর প্রধান কাঁচামাল পাটি গাছের ছাল। এর সাথে প্রয়োজন হয় বিভিন্ন নকশার প্রয়োজনীয় রং। বিবি হাজেরা নামে একজন নারী জানান, স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল কেনা যায়। বিভিন্ন পরিবার পাটি বোনার পাশাপাশি পাটিগাছের চাষ করে থাকে।

ছনুয়া ইউনিয়নের পেয়ারা বেগম জানান, ৩৪ শতক জমিতে তারা পাটি গাছের চাষ করেন। উক্ত জমি হতে ২শ হতে ২শ ২০ মুঠি ছাল বিক্রয় করা যায়। প্রতি মুঠির বাজার দর ২৫০টাকা।

পাটির বড় বাজার বসে লেমুয়াতে। সাপ্তাহে রবিবার ও বুধবার বাজার তারিখে মহিলারা এবং পরিবারের পুরুষ সদস্যরা পাটি নিয়ে হাটে আসে। আড়তদার ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা পাটিগুলো কিনে জমা করে। এরপর একসাথে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে।

লেমুয়া বাজারে তালুকদার ট্রেডার্সের মালিক নজরুল ইসলাম শাহীন জানান, এ বাজারে ১০জন বড় আড়তদার রয়েছেন। এছাড়া আরও ১০-১২জন ব্যবসায়ী পণ্য কেনেন। তিনি জানান, গরমের ছয় মাস পাটির ব্যাপক কদর থাকে। এসময় প্রতি বাজারে লেমুয়াতে ১২ হতে ১৫ লাখ টাকার পণ্য কেনা হয়। একইভাবে বক্তারমুন্সী বাজারেও সুদিনে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়। তবে গরম কমার সাথে সাথে পাটির চাহিদা কমতে থাকে।

লস্কর হাট বাজারের পাটি ব্যবসায়ী আলমগীর জানান, এখানে সাপ্তাহে দুইদিন বাজার বসে। গরমের সময় প্রতি বাজারে ৪ হতে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত পাটি কেনা হয়। তবে বর্তমানে তা কমে ২ লাখে নেমে এসেছে।

ব্যবসায়ী শাহীন জানান, পাটির বাজারে মুলত নারীরা পণ্যের যোগান দিয়ে থাকে। তাদের তৈরী পণ্যের উপর গড়ে উঠেছে বিশাল এ বাজার।

বিলুপ্ত প্রায় এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে উদ্যোক্তা সৃষ্টির ব্যাপারে জোর দিয়েছেন ফেনী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাসরীন সুলতানা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রায় প্রতিটি জেলার কিছু না কিছু বিশেষ পণ্য আছে। ফেনীর সেই বিশেষ পণ্য হচ্ছে ‘পাটি’। আমি অনেকগুলো উঠান বৈঠকে গিয়ে মহিলাদের বলেছি তারা যাতে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করে। প্রয়োজনে আমরা সকল সহযোগিতা দেব। কিন্তু এ ব্যাপারে তারা তেমন আগ্রহী নয়। এটিকে তারা পেশা নয় বরং অবসরে সময় কাটানোর কাজ হিসেবে নিচ্ছে।

ইউএনও বলেন, তাদেরকে উৎসাহী করে আরও বেশি উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে পারলে এ বিলুপ্তপ্রায় শিল্পের পরিধি আরও বৃদ্ধি করা যেত।