ফুলে ফুলে ভরে গেছে তার কবর। উপচে পড়া ফুলের সারি যেন প্রকাশ করছে তার প্রতি মানুষের নিখাদ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশের আবরণ। সর্বস্তরের জনসাধারণের শ্রদ্ধায় বিদায় জানানো হল ফেনী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও প্রতিথযশা রাজনীতিবিদ আজিজ আহম্মদ চৌধুরীকে।

আজ সোমবার বাদ মাগরিব ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ আনন্দপুর গ্রামের হাসানপুর চৌধুরী বাড়ী প্রাঙ্গনে ২য় জানাযা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে স্ত্রীর কবরের পাশে চির শয্যায় শায়িত করা হয়েছে।

এর আগে বাদ আছর ফেনী মিজান ময়দানে তার প্রথম নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ। তাদের উপস্থিতিতে কানায় কানায় ভরে উঠেছিল মিজান ময়দান। সাংসদ, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, জনপ্রতিনিধি, পদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ, ছাত্র ও বহু সাধারণ মানুষ এসেছিলেন বহু গুণের অধিকারী এই মানুষটিকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে।

জানাযা পূর্বে ফেনী পৌরসভার কাউন্সিলর বাহার উদ্দিন বাহারের সঞ্চালনায় মরহুমের জীবন ও কর্মের উপর আলোকপাত করে বক্তব্য রাখেন ফেনী ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। এসময় তিনি বলেন, উনি বিরল এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী। গত ৪০ বছর ধরে উনাকে আমি দেখেছি। তিনি সৎ এবং পরিচ্ছন্ন মানুষ, পরিচ্ছন্ন নেতা ছিলেন। নাছিম বলেন, তার সন্তানরা চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিতে চাইলেও তিনি যান নি। ফেনীর মাটিতেই তিনি মৃত্যুবরণ করতে চেয়েছেন। তিনি ছিলেন, মাটি ও মানুষের নেতা। এসময় তরুণ প্রজন্মকে তার আদর্শ ধারণ করে স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন এবং সৎ নেতা হিসেবে নিজেদেরকে গড়ার তোলার জন্য আহ্বান জানান তিনি।

বক্তব্যে ফেনী-২ আসনের সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী বলেন, আজিজ আহম্মেদ চৌধুরী কেমন লোক ছিলেন তা আপনারা জানেন। এ ধরনের সৎ জনপ্রতিনিধি বাংলাদেশের ইতিহাসে আছে কিনা তা আমার জানা নেই। সাংসদ বলেন, আমাদের সবাইকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। কিন্তু আজকে উনি যে সম্মান নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, সেই সম্মানটুকু যেন আমরাও পাই, আল্লাহর কাছে এ ফরিয়াদ করি। এসময় উপস্থিত সকলে তার জন্য দোয়ার করার অনুরোধ করেন নিজাম হাজারী।

বক্তব্য প্রদানকালে জেলা প্রশাসক মোঃ ওয়াহিদুজজামান বলেন, তার মৃত্যুতে জেলা প্রশাসন গভীর শোকাহত। তিনি ছিলেন সৎ, নির্ভীক এবং আমাদের অভিবাবক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি আমাদের সবসময় পরামর্শ দিতেন এবং অনেক ভালো ভালো কথা বলতেন যেগুলো আমাদের কাজে লেগেছে। জেলা প্রশাসক বলেন, গত ২ তারিখও আমাদের সাথে তিনি সভা করেছেন। কিন্তু আজ এভাবে চলে যাবেন সেটা অভাবনীয়। এসময় তার স্মৃতি রক্ষার্থে ফেনী জেলায় তার নামে কোন সড়ক অথবা স্মৃতিচারণমূলক কিছু করার জন্য উপস্থিত সকলের প্রতি অনুরোধ জানান জেলা প্রশাসক।

ফেনী সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বিকম বলেন, ফেনী জনপদের অত্যন্ত প্রিয় এক নেতা আজ এখানে কফিনবন্দী হয়ে শুয়ে আছেন। তিনি আপনাদের, আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় মানুষ ছিলেন। আমি আজিজ আহম্মদ চৌধুরী সাহেবের সাথে দীর্ঘদিন একত্রে রাজনীতি করেছি। তিনি আমাদের অত্যন্ত প্রিয় মানুষ ছিলেন।

জেলা পরিষদের পক্ষে বক্তব্য প্রদান করেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু দাউদ মোঃ গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে ৫ বছর ও চেয়ারম্যান হিসেবে সাড়ে তিন বছর মোট সাড়ে আট বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। সত্যিকার অর্থে উনি কি রকম ভালো মানুষ ছিলেন আপনারা সবাই জানেন। জেলা পরিষদের সাধ্য সীমিত থাকলেও ফেনীর গণমানুষের জন্য তিনি প্রতিনিয়ত কাজ করে গেছেন।

পরিবারের পক্ষে বক্তব্য প্রদানকালে আজিজ আহম্মদ চৌধুরী ছোট ছেলে জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) চৌধুরী আহমেদ রিয়াদ আজীজ রাজীব জানাযায় অংশগ্রহণের জন্য পরিবার, পরিজন, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধবসহ উপস্থিত সকলের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বাবার জন্য সকলের কাছে দোয়া কামনা করেন তিনি।

তার জানাযায় ইমামতি করেন স্টেশন রোড জামে মসজিদের খতিব মুফতি মনছুরুল হক। জানাযা শেষে মরহুমের কফিনে পুস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানায় ফেনীর সর্বস্তরের মানুষ। জানাযা শেষে তার মরদেহ ফুলগাজীর আনন্দপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অনুষ্ঠিত জানাযা পূর্বে বক্তব্য রাখেন তার ছোট ভাই আমির আহমেদ চৌধুরী রতন, পরশুরাম উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন মজুমদার, ফুলগাজী উপজেলা সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল আলিম মজুমদার, সাধারণ সম্পাদক ও আনন্দপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হারুন মজুমদার, মরহুমের চাচাতো ভাই বিএনপি নেতা মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী মিনার প্রমুখ। জানাযায় ইমামতি করেন দক্ষিণ আনন্দপুর মাইজগ্রাম জামে মসজিদের খতিব মাওলানা নুরুল হুদা।

এর আগে আজ ভোররাত ফেনী ডায়াবেটিস হাসপাতাল হতে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া স্টেশন রোডস্থ বাসভবনে। দিনভর সেখানে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে জড়ো হন নানা শ্রেণীর পেশার মানুষ। এরপর সাড়ে তিনটার দিকে তার মরদেহ নেয়া হয় ফেনী মিজান ময়দানে।

আজ সোমবার (৭ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত ২ টা ২০ মিনিটের দিকে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ফেনী ডায়াবেটিস হাসপাতালে মারা গেছেন ফেনীর এ প্রতিথযশা রাজনীতিবিদ। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। মৃত্যুকালে তিনি ২ ছেলে ও ২ মেয়েসহ আত্মীয় স্বজন, অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখেন গেছেন।

আজিজ আহাম্মদ চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেছেন তারা।