বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চেয়ারপারসন করে ‘ডেল্টা গভর্ন্যান্স কাউন্সিল’ গঠন করেছে সরকার। ১২ সদস্যের এই কাউন্সিল গঠন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে গত বুধবার ( ২ জুলাই) প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এই কাউন্সিলের চেয়ারপারসন। পরিকল্পনামন্ত্রীকে কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়েছে।

বন্যা, নদীভাঙন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদী কৌশল হিসেবে ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর আলোচিত ‘বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)।

ডেল্টা প্ল্যান নামে পরিচিত শত বছরের এ মহাপরিকল্পনার অধীনে আপাতত ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য ৮০টি প্রকল্প নেবে সরকার। ডেল্টা গভর্ন্যান্স কাউন্সিলে সদস্য হিসেবে রয়েছেন- কৃষিমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, ভ‚মিমন্ত্রী এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্যকে এই কাউন্সিলের সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এই কাউন্সিলকে ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নে নীতিনির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কৌশলগত পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিতে হবে।

ডেল্টা প্ল্যান হালনাগাদকরণে দিক-নির্দেশনা দেয়া ছাড়াও এই প্ল্যানের বিনিয়োগ পরিকল্পনা প্রণয়নে কাউন্সিলকে নীতিনির্ধারণ ও নির্দেশনা দিতে বলা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কাউন্সিলকে বছরে ন্যূনতম একটি সভা করতে হবে। কাউন্সিল প্রয়োজনে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। জানা গেছে, ২০১৮ সালে সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় (এনইসি) ‘বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ অনুমোদন দেয়া হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করে দেশকে কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সে বিষয়টি মাথায় রেখেই এই ডেল্টা প্ল্যান। প্রকল্পটির মূল প্রতিপাদ্য জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো।

ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, নদীভাঙন, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় আমাদের নিত্যসঙ্গী। ভূমি ক্ষয় বড় সমস্যা। নদীভাঙনের ফলে প্রতিবছর ৫০ থেকে ৬০ হাজার পরিবার গৃহহীন হচ্ছে। বন্যায় ব্যাপক ফসলহানি হচ্ছে। এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি তো রয়েছেই। মানবসৃষ্ট নানা কারণে প্রাকৃতিক পানিচক্র বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। কমে যাচ্ছে পানির গুণগত মান ও প্রাপ্যতা। বাড়ছে লবণাক্ততা ও মিঠা পানির স্বল্পতা। এছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণতা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য বন্যা, খরা, সাইক্লোনের ঝুঁকি বাড়ার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া বজ্রপাত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করাও দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ বাস্তবতায় পানি ব্যবস্থাপনা, কৃষি, মৎস্য, খাদ্য নিরাপত্তা, শিল্প, বনায়নসহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয় বিবেচনায় রেখে এই সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। উৎপাদন শক্তি না কমিয়ে কৃষিজমিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার, শহরাঞ্চলে সুপেয় পানি নিশ্চিত করা, বর্জ্য ও আবর্জনা ব্যবস্থাপনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আছে বদ্বীপ পরিকল্পনায়।

বদ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দেশের অঞ্চলগুলোকে ভাগ করা হয়েছে ছয়টি অঞ্চলে। এগুলো হচ্ছে- উপকূলীয় অঞ্চল, বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল, হাওর ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, নদী ও মোহনা অঞ্চল এবং নগরাঞ্চল। একই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকির সম্মুখীন জেলাগুলো থাকছে একেকটি গ্রুপের আওতায়। এসব হটস্পটে চিহ্নিত করা হয়েছে ৩৩ ধরনের চ্যালেঞ্জ। বিবেচনায় নেয়া হয়েছে প্রতিটি অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকির মাত্রা।

বদ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গঠন করা হবে ডেল্টা তহবিল। তহবিলের সম্ভাব্য উৎস বাংলাদেশ সরকার, বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী, পরিবেশ ও জলবায়ু সম্পর্কিত তহবিল। সরকারি- বেসরকারি অংশীদারিকেও (পিপিপি) বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গঠন করা হবে ডেল্টা কমিশন। এতে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯ হাজার ৭৮২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে ২০৩০ সাল নাগাদ জিডিপির ২.৫ শতাংশ পরিমাণ অর্থায়ন দরকার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

নেদারল্যান্ডসের ডেল্টা ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশে বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ প্রণয়ন করা হয়েছে। তিন বছর আগে এই পরিকল্পনা তৈরির কাজ শুরু করে সরকার। এতে সহায়তা করেছে নেদারল্যান্ডস। পরিকল্পনা তৈরির জন্য ৪৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা অনুদানও দিয়েছে দেশটি। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করে ধাপে ধাপে এটি বাস্তবায়ন করা হবে।

সূত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব