করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পেয়েছে ফেনীর দাগনভূঞার উপজেলার পূর্বচন্দ্রপুর ইউনিয়নের দিগেন্দ্র ব্যাপারী বাড়িতে শতবছরের বৃদ্ধা কিরণ বালা। সাথে মুক্তি পেয়েছে ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা পূজারিণীসহ ১৮জন সদস্য।

বাড়িতে সর্বপ্রথম হরিলাল দেব নাথের জ্বর, সর্দি, কাশি, গলাব্যথাসহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়। এরপর তার পরীক্ষার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে লোকজন এসে নমুনা নেয়। তার নমুনার ফলাফল পজিটিভ আসে।

হরিলাল দেবনাথের বৈরাগীর হাটে তার নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তার নিজের ধারণা, ঢাকা থেকে আসা বিভিন্ন লোকজনের সংস্পর্শে এই ভাইরাস তাকে আক্রান্ত করেছে। ৩০ মে তার নমুনা পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ হয়। কিন্তু তার আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন ও স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন নির্দেশনা মেনে তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন।

হরিলাল দেবনাথের সংস্পর্শে আসা তার বাড়ির কিরন বালা, বজ্র গোপাল নাথেরও করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়। পরবর্তীতে তাদের সংস্পর্শে আসা ছয়জনের করোনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্য থেকে তিনজনের করোনো পজিটিভ আসে। এ নিয়ে একই বাড়িতে ৬ জন রোগী শনাক্ত হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে পুরো বাড়ির ৩৫ জনের করোনা নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ১২ জন এর ফলাফল পজিটিভ হয়। এ নিয়ে বাড়ীটিতে ১৮ জনের করোনা শনাক্ত হয়।

বিগেন্দ্র ব্যাপারী বাড়ীতে তিন পরিবারে ৪১ জন সদস্যের বসবাস। এর মধ্যে ১৮ জনের করোনা পজেটিভ শুনে বাড়ীর সকলে দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়েন। শুরুতে আশপাশের লোকজন তাদের ভিন্ন চোখে দেখত। যদিও পরবর্তীতে আশপাশের লোকজনের সহযোগিতায় তারা সুস্থ হয়ে উঠেন।
শত বছরের বৃদ্ধা কিরণ বালা জানান, আমি অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আমার ছেলে, ছেলের বউ, নাতি সবাই আমার অনেক সেবা যত্ন করেছে। তারা আমাকে অনেক দেখাশুনা করেছে। সবসময় গরম জল খেতে দিয়েছে, গরম জল দিয়ে গোসল করিয়েছে, ঠিকমতো ওষুধ দিয়েছে। আগের চেয়ে এখন ভালো খেতে পারি।

ব্রজ গোপাল জানান, এমন একটা সময় আমরা নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি। আমাদের বাজার পর্যন্ত কেউ করে দেয়নি। আমরা অনেকদিন নিজেরা নিজেদের বাড়ি থেকে জিনিসপত্র জোগাড় করে খেতে হয়েছে। পরে বন্ধুবান্ধব আশপাশের লোকজন আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমাদের বাড়ির সামনে তারা বাজারগুলো এনে রেখে দিত আমরা সেখান থেকে গিয়ে নিয়ে আসতাম এভাবেই আমরা এক মাস ১০দিন কাটিয়েছি।

চন্দন দেবনাথ জানান, সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা নিজেদের সুরক্ষা করেছি। পাশাপাশি ডাক্তারদের বিভিন্ন পরামর্শ ও ঔষধ সেবনের মাধ্যমে করোনাভাইরাস এর সাথে মোকাবেলা করেছি। এখন আমরা কিছুটা সুস্থ হলেও শঙ্কায় রয়েছে।

এদিকে লিটন কুমার নাথ জানান, মরণব্যাধি করোনাভাইরাস যখন ধরা পড়ে। তখন আমরা নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলাম এবং আমাদের মনোবল ভেঙে পড়েছিল। মাকে নিয়ে একটু দুঃশিচন্তায় ছিলাম, যেহেতু উনার বয়স হয়েছে, টুকটাক শারীরিক সমস্যাও ছিল। তবে দুই এক দিন পর যখন চিকিৎসকের পরামর্শে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা শুরু করলাম। তখনই মনোবল আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পেতে লাগল এবং সুস্থ হতে লাগলাম।

পুষ্প রানী দেবনাথ জানান, আমরা খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু আলাদা আলাদাভাবে করেছি। যারা সুস্থ রয়েছে তারা যেন সংক্রমিত না হয়। সেজন্য আমরা সবকিছু আলাদা আলাদাভাবে করেই সুস্থতার অপেক্ষা করেছি।

পলাশ দেবনাথ জানান, আমাদের পুরো বাড়ি লকডাউন করে দেওয়া হয়েছে। আমরা আর বাড়ি থেকে বের হতে পারছি না। তখন আমার বন্ধুবান্ধব ও আশপাশের লোকজন প্রথম অবস্থায় একটু ভয় পেলেও পরবর্তীতে তারা আমাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছে। বিভিন্ন জিনিসপত্র, বাজার করে সব ধরনের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে তারা।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ রুবাইয়াত বিন করিম জানান, তারা যখন অসুস্থ হয় তখন থেকে আমরা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র দিয়ে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছি। আমাদের চিকিৎসকদের টিম পাঠিয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছি এবং জিনিসপত্র যা যা প্রয়োজন সব কিছু সরবরাহ করেছি। দুইদিন পরপর টেলিফোনের মাধ্যমে তাদের খবর নিয়েছি।

তিনি বলেন, যখন আমরা দেখতে পাই ঐবাড়ীতে লক্ষণযুক্ত আর কোনো রোগী নেই। তখন আমরা ওদের দ্বিতীয় নমুনা সংগ্রহ করি। ২৯ জুন রিপোর্টে ফলাফল নেগেটিভ এসেছে। আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ ছিল ওই বাড়িতে শত বছরের এক বৃদ্ধা ও নয় মাসে প্রসূতি মা যার জন্য আমরা অধিক চিন্তিত ছিলাম। তাদের ফলোআপ এবং শারীরিক অবস্থা আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ ছিলো। রোগীদের সর্বাত্মক সহযোগিতায় আমরা তাদের করোনা ভাইরাস থেকে উত্তীর্ণ করতে পেরেছি।